All writings in Bengali and Sanskrit including brief works written for the newspaper 'Dharma' and 'Karakahini' - reminiscences of detention in Alipore Jail.
All writings in Bengali and Sanskrit. Most of the pieces in Bengali were written by Sri Aurobindo in 1909 and 1910 for 'Dharma', a Calcutta weekly he edited at that time; the material consists chiefly of brief political, social and cultural works. His reminiscences of detention in Alipore Jail for one year ('Tales of Prison Life') are also included. There is also some correspondence with Bengali disciples living in his ashram. The Sanskrit works deal largely with philosophical and cultural themes. (This volume will be available both in the original languages and in a separate volume of English translations.)
জাতীয় মহাসভা
যে দিন সুরাটে জাতীয় মহাসভার বিভ্রাট ঘটিয়াছিল, জাতীয়দলের সম্মিলনীর অধিবেশনে শ্ৰীযুত তিলক মহাসভার জাতীয়তা রক্ষা করিয়া ঐক্য স্থাপনের উপায় উদ্ভাবন ও মহাসভার কাৰ্য্য ও উদ্দেশ্য রক্ষাৰ্থ কমিটী নিযুক্ত করিবার প্রস্তাব করিয়াছিলেন ৷ সেই প্রস্তাব অনুসারে কমিটী গঠনও হইল, কিন্তু আজ পর্যন্ত কমিটীর অধিবেশন হয় নাই ৷ শ্ৰীযুত অরবিন্দ ঘােষ ও শ্ৰীযুত বােডাস এই কমিটীর সম্পাদক নিৰ্বাচিত হইয়াছিলেন ৷ তাহারা পরামর্শ করিয়া ইহাই নির্ণয় করিলেন যে, এই বিভ্রাট সম্বন্ধে জাতীয়দলের দোষক্ষালন করা ও প্রাদেশিক সমিতি সকলের অধিবেশনে ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে দেশবাসীর অভিমত জানা প্রথম কর্তব্য, তৎপূৰ্ব্বে কমিটী আহ্বান করা বৃথা ৷ এই গুরুতর বিষয়ে দেশবাসীর মত উপেক্ষা করিয়া পরামর্শ করা কোনও মতে বিধেয় বা যুক্তিসঙ্গত নয় ৷ দুইটী প্রাদেশিক সমিতির অধিবেশনে জানা গেল যে, বঙ্গদেশের ও মহারাষ্ট্রের মতে ঐক্য স্থাপনই শ্রেয়স্কর এবং মহাসভার পূর্ববর্তী প্রণালী ও কলিকাতার অধিবেশনে গৃহীত চারিটী মুখ্য প্রস্তাব সৰ্বৰ্থ রক্ষণীয় ৷ এলাহাবাদে কনভেনসনের কমিটী এই মত অগ্রাহ্য করিয়া ঐক্য স্থাপনের পথ বন্ধ করিল ৷ তাহার পরেই আলিপুরে বােমার মােকদ্দমায় শ্ৰীযুত অরবিন্দ ঘােষ ধৃত ও অভিযুক্ত হইলেন ৷ মহামতি তিলক রাজদ্রোহের অভিযােগে ছয় বৎসর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইলেন, শ্ৰীযুত খাপাদ্দে ও শ্ৰীযুত বিপিনচন্দ্র পাল বিলাতে প্রস্থান করিলেন, বঙ্গদেশীয় জাতীয় দলের প্রধান প্রধান নেতাগণ নির্বাসিত হইলেন ৷ দেশময় প্রবল নিগ্রহনীতিরূপ ঝটিকা বহিতে লাগিল ৷ জাতীয় দলের নেতাগণের মধ্যে নাগপুর নিবাসী ডাক্তার মুঞ্জী, কলিকাতার শ্ৰীযুত রসুল এবং মধ্যস্থগণের মধ্যে পঞ্জাবের লালা ৷ রায় ও বঙ্গদেশের শ্রীযুত মতিলাল ঘােষই রহিলেন ৷ ডাক্তার মুঞ্জী প্রভৃতি কলিকাতায় আসিয়া ঐক্যস্থাপনের অনেক চেষ্টা করিলেন কিন্তু কয়েকজন সন্ত্রান্ত মধ্যপন্থীর প্রতিবাদে তাহাদের প্রস্তাবসকল প্রত্যাখ্যাত হইল ৷ জাতীয় দলের নেতাগণ বিফলমনােরথ হইয়া নাগপুরে জাতীয় মহাসভার অধিবেশনে কৃতসঙ্কল্প হইলেন ৷ তাহাও রাজপুরুষদের আজ্ঞায় স্থগিত হইল ৷ এই অনুকূল অবস্থায় কভেন্ কমিটীর নির্ধারিত নিয়মাবলী অনুসারে মাদ্রাজে কনভেত্স সম্মিলিত হইয়া জাতীয় মহাসভা নাম ধারণ পূর্বক বয়কট বর্জন দ্বারা বঙ্গদেশের মুখে চুণকালি মাখাইল, বঙ্গদেশের মধ্যপন্থী নেতাগণও নীরবে এই লাঞ্ছনা সহ্য করিয়া সহ্যশক্তির পরাকাষ্ঠা দেখাইলেন ৷ এই বৎসর লাহােরে এই কৃত্রিম মহাসভার অধিবেশনের আয়ােজন চলিতেছে ৷ এই আয়ােজনে শ্ৰীযুত নন্দী, লালা হরকিসনলাল ও পণ্ডিত রামভুজদত্ত চৌধুরী ত্রিমূৰ্ত্তি সাজিয়া, অসৎ হইতে সৎ সৃষ্টি করিয়া ঐশী শক্তির লক্ষ্য প্রকাশ করিতেছেন ৷ পঞ্জাবের প্রভাবশালী হিন্দুসভা সেই প্রদেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে এই কৃত্রিম মরলীর ভেদনীতির পক্ষপাতী জাতীয় মহাসভার জাতীয়তা অস্বীকার করিতে আহ্বান করিতেছেন; লালা লাজপত রায়, লালা মুরলীধর, লালা দ্বারকাদাস প্রভৃতি সন্ত্রান্ত নেতাগণ এই আয়ােজনের প্রতিবাদ করিয়াছেন, মুসলমান সম্প্রদায়ও এই রাজ-অনুগ্রহ-লালিত মহাসভায় যােগ দিতেছেন না ৷ অতএব এই আয়ােজনের সফলতা সম্বন্ধে আশা পােষণ করা যায় না ৷ এই অবস্থায় ঐক্য স্থাপনের একমাত্র আশাস্থল হুগলীতে প্রাদেশিক সমিতির অধি-বেশন ৷ এই অধিবেশনে যদি ঐক্যস্থাপনের প্রকৃত প্রণালী নির্ধারিত হয় এবং বঙ্গদেশের মধ্যপন্থীগণ গােখলে-মেহেতার আধিপত্য পরিত্যাগ করিয়া দেশের মুখের দিকে চাহিয়া স্বপন্থা নির্ধারণ করেন, তাহা হইলে জাতীয় মহাসভার সম্বন্ধে সন্তোষজনক উপায় উদ্ভাবন করিয়া একতার পথ নিষ্কণ্টক করা যাইবে ৷ গােখলে মহাশয় পুণার বক্তৃতায় যে দেশদ্রোহিতা করিয়াছেন, তাহার পরে তাহার কথায় দেশের অহিত-সাধন বঙ্গদেশীয় নেতাদিগের পক্ষে অতিশয় লজ্জাজনক হইবে ৷ বােম্বাইয়ের নেতাগণ যে বয়কট ও বৈধ প্রতিরােধকে দমন করিতে কৃতনিশ্চয় হইয়া-ছেন, তাহার সম্বন্ধে আর কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তির সন্দেহ থাকিতে পারে? সুরেন্দ্রবাবু বিলাতে বয়কট সমর্থন করিয়াছিলেন বলিয়া বােম্বাইয়ের নেতৃবৃন্দ এত বিরক্ত হইয়াছেন যে, বিলাত হইতে পুনরাগমনকালে শ্ৰীযুত ওয়াচা ভিন্ন একজন সুপ্রসিদ্ধ মধ্যপন্থীও সুরেন্দ্রবাবুকে অভ্যর্থনা করিতে যান নাই ৷ তাহারা নাকি বয়কট নীতির সহিত তাহাদের সহানুভূতির অভাব ঘােষণার্থ এইরূপে বঙ্গদেশের মধ্যপন্থী নেতাকে অপদস্থ করিয়াছিলেন ৷ লাহােরের সভা জাতীয় মহাসভাও নয়, মধ্যপন্থীদলের মহাসভাও নয়, বয়কট-বিরােধী রাজপুরুষভক্তের মহাসভা ৷ যাহা হউক, জাতীয় দল হুগলীর অধিবেশন পৰ্য্যন্ত অপেক্ষা করিতেছেন, তাহার পরে আপনাদের গন্তব্য পথ নির্ধারণ করিবেন ৷ আমরা আর পরমুখাপেক্ষী হইয়া নিশ্চেষ্ট থাকিব না ৷
হিন্দু ও মুসলমান
শাসন সংস্কারে হিন্দু ও মুসলমানের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব অবলম্বন করিয়া বিরােধ বদ্ধমূল করিবার চেষ্টায় অনিষ্টের মধ্যে এই হিতও সাধিত হইয়াছে যে, নির্জীব মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে জীবন-স্পন্দন হইয়াছে ৷ তাহারা রাজপুরুষদের উপর দাবী করিতে এবং অসাধ্যসাধনের আশা পােষণ করিতে শিখিতেছেন ৷ ইহাতেই দেশের পরম মঙ্গল ৷ উহাদের আশা যে ব্যর্থ হইবে, তাহা বলা নিষ্প্রয়ােজন ৷ ইতিমধ্যে তাহা রাজপুরুষদের আচরণে বুঝা গেল ৷ তাহারা যেমন অপর দেশবাসীদিগকে ক্ষুদ্র ও মূল্যহীন অধিকার দান করিয়া ক্ষান্ত হইয়াছেন, মুসলমান সম্প্রদায়কেও সেইরূপ ক্ষুদ্র ও মূল্যহীন অধিকারমাত্র দান করিয়া প্রকৃত শক্তি-বিকাশের উপায় দিতে অসম্মত হইবেন ৷ পৃষ্ঠপােষক ও সহানুভূতি-প্রকাশক ইংরাজ আমাদিগকে আশা দিয়া যেমন নিবেদন-নীতিপ্রিয় করিয়াছিলেন, তাঁহাদেরও সেইরূপ পৃষ্ঠপােষক ও সহানুভূতি-প্রকাশক জুটিবেন ৷ শেষে মুসলমান ভ্রাতৃগণ বুঝিতে পারিবেন যে, এই নিবেদননীতি ফলপ্রসূ নয় এবং উহাদের প্রকৃত উপকার করিবার সামর্থ্য ইংরাজ পৃষ্ঠপােষকগণের নাই ৷ আমরা যদি এই শাসনপ্রণালীতে যােগদান করিতে অসম্মত হই, তবেই জাগরণের দিন শীঘ্র আসিবার সম্ভাবনা থাকিবে ৷ যদি এই ভেদনীতিমূলক শাসনপ্রণালীতে যােগদান করিয়া মুসলমানদের সহিত সংঘর্ষে প্রবৃত্ত হই, তাহা হইলে আমরা যে অনিষ্টের সম্ভাবনা দেখাইলাম তাহা নিশ্চয়ই ফলিবে ৷ যদিও আমরা কাহারও প্রতিকূলতা ভয় করি না, তথাপি বিপক্ষের উদ্দেশ্যসাধনে সাহায্য করা মূর্খতা মাত্র ৷ আমরা কখনও মুসলমান ভ্রাতৃগণের তােষামােদ করি নাই, করিবও না, সরলমনে এক প্রাণ হইয়া তাহাদিগকে জাতি সংগঠন কার্য্যে ব্রতী হইতে আহ্বান করিয়াছি ৷ সেই আহ্বান শ্রবণ করিয়া নিজের হিত ও কর্তব্য নির্ধারণ করা তাহাদের বুদ্ধি, ভাগ্য ও সাধুতার উপর নির্ভর করে ৷ আমরা বিরােধ সৃষ্টি করিতে যাইব না ও বিপক্ষের বিরােধ সৃষ্টির চেষ্টায় সাহায্য করিব না ৷
পুলিস বিল
সার এডওয়ার্ড বেকার পুলিস বিল স্থগিত করিয়াছেন ৷ তিনি বুদ্ধিমানের কাৰ্য্যই করিয়াছেন ৷ এই বিল আইনবদ্ধ হইলে যে অশান্তি ও অনর্থ ঘটিত, সংবাদপত্রে প্রতিবাদে ও বক্তৃতায় কতক পরিমাণে ও অস্পষ্টভাবে তাহার আভাস দেওয়া হইয়াছে ৷ স্রোত ফিরিয়াছে ৷ আমরা ৭ই আগষ্ট ভয় ও বিঘ্ন অতিক্রম করিয়া পরীক্ষোত্তীর্ণ হইয়াছি বলিয়া বুঝি ভগবান সুপ্রসন্ন হইয়াছেন ৷ কুদিন অবসান হইতে যাইতেছে, সুদিন ফিরিয়া আসিতেছে ৷ আশা করিতে পারি যে, ইহার পরে জাতীয় শক্তির জয় ভিন্ন পরাজয় হইবে না ৷ সেই শক্তির পুনর্বিকাশ, লােকমতের জয় ও চেষ্টার মঙ্গলময় পরিণামের পূর্বলক্ষণ পাওয়া যাইতেছে ৷ বঙ্গদেশের বর্তমান ছােটলাটের মত প্রজাতন্ত্রের পক্ষেই আছে, ইহা জানা কথা, কিন্তু তাহার কাৰ্য্য ও প্রকাশ্য কথা প্রজাতন্ত্রের প্রতিকূল হইয়াছে ও হইবে ৷ তিনি লর্ড মরলীর আজ্ঞাবাহক ভৃত্য মাত্র, কেরাণীতন্ত্র (Bureaucracy)র প্রধান কেরাণী মাত্র, স্বতন্ত্র মত কাৰ্যে পরিণত করিবার স্বাধীনতা তঁাহার নাই ৷ তথাপি পুলিস বিল স্থগিত হওয়ায় তাহার মন হইতে একটা চিন্তার ভার অপনীত হইবার কথা ৷ আমাদের বিশ্বাস, তিনি স্বতঃপ্রণােদিত হইয়া এই অনিষ্টকর বিল রুজু করেন নাই, স্বতঃপ্রণােদিত হইয়া স্থগিতও করেন নাই ৷ বিলটী স্বর্গরাজ ইন্দ্রের বজ্রপাত নয়, আরও উচ্চ শৈলশিখরারূঢ় কখন সৌম্যমূৰ্ত্তি কখন রুদ্রমূৰ্ত্তি কোন সদাশিবের আদেশ-প্রসূত মহাস্ত্র ৷ আমাদের অনুমান যদি অমূলক না হয়, তাহা হইলে বুঝিতে হইবে নিগ্রহনীতির জন্মস্থানে নিগ্রহমূদ্রা শিথিল হইয়া পড়িতেছে ৷ ইহা কি cooperation আকাঙ্ক্ষার ফল? কেহ যেন এই ভ্রান্তির বশবর্তী না হন যে, আমরা এত অল্পে ভুলিব ৷ রাজনীতি প্রেমের মান মিলনের খেলা নয়; রাজনীতি বাজার, ক্রয় বিক্রয়ের স্থান ৷ সেই বাজারে cooperationএর মূল্য control ৷ অল্প মূল্যে বহুমূল্য বস্তু ক্রয় করিবার দিন চলিয়া গিয়াছে ৷
জাতীয় রিসলী সারকুলার
আমরা জাতীয় শিক্ষাপরিষদকে জানাইতেছি যে, তাঁহারা ৭ই আগষ্টে পরিষদের অধীন স্কুলসকলের ছাত্রবৃন্দকে বয়কট উৎসবে যােগদান করিতে নিষেধ করায় মফঃস্বলে অতিশয় কুফল ফলিতেছে ৷ সাধারণ লােকের মন ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত হইয়াছে; যাঁহারা জাতীয় শিক্ষার সাহায্য করিতেন, তাহারা অনেকে সাহায্য বন্ধ করিতেছেন; এবং এই মত প্রচারিত হইতেছে যে, জাতীয় স্কুল কলেজে ও সরকারী স্কুল কলেজে নামমাত্র প্রভেদ বর্তমান ৷ শুনিয়াছি পরিষদের একজন বিখ্যাত সভ্য ছাত্রগণকে এই পরামর্শ দিয়াছেন যে, যাঁহারা দেশের কাৰ্য্যে যােগদান করিতে চান, তাহারা সরকারী কলেজের আশ্রয় গ্রহণ করুন ৷ পরিষদের ইহাও মত হইতে পারে যে, মফঃস্বলের স্কুল সকল বন্ধ হউক, সাধারণ লােক সাহায্য বন্ধ করুন, আমরা বড় বড় লােকের অর্থ সাহায্যে কলিকাতায় একটীমাত্র কলেজ চালাইয়া নিষ্কৃতি পাইব ৷ যদি তাহাই হয় তবে সব ল্যাঠা চুকিয়া গেল ৷ অন্যথা এই জাতীয় রিসলী সারকুলার প্রত্যাহার করা আবশ্যক ৷
গুপ্ত চেষ্টা
বিশ্বস্ত সূত্রে অবগত হইলাম যে যাহাতে শ্রীযুক্ত অরবিন্দ ঘােষ কোনও জেলা-সমিতি দ্বারা হুগলীর অধিবেশনে প্রতিনিধি নিযুক্ত না হন কয়জন পরম দেশহিতৈষী সেজন্য গােপনে চেষ্টা করিয়াছে ৷ এই জঘন্য নীতি এখনও আমাদের রাজনীতিতে স্থান পায়, ইহা বড় দুঃখের কথা ৷ অরবিন্দ বাবুকে যদি বয়কটই করিতে হয়, করুন ৷ তাহাতে তাহার আপত্তি নাই, তিনি দুঃখিত হইবেন না, দেশের কাৰ্যে পশ্চাৎপদও হইবেন না ৷ তিনি কখনও কাহারও মুখাপেক্ষী হইয়া কাৰ্য্য করেন নাই, পূৰ্ব্বে অনেকদিন স্বপথে একাকী অগ্রসর হইয়াছিলেন, ভবিষ্যতেও যদি একাকী যাইতে হয়, যাইতে ভয় করিবেন না ৷ কিন্তু যদি এই মতই গৃহীত হয় ৷ যে, দেশের হিতের জন্য বা আপনাদের উদ্দেশ্যসাধনের জন্য অরবিন্দ বাবুর সংস্রব বর্জনীয়, প্রকাশ্যে দেশের সমক্ষে দণ্ডায়মান হইয়া এই মত প্রচার করিতে কণ্ঠিত হন কেন? এই গুপ্ত ষড়যন্ত্রের দ্বারা আপনাদের বা দেশের কি হিত সাধিত হইবে, তাহা বুঝা যায় না ৷ ইতিমধ্যেই ডায়মণ্ডহারবার হইতে অরবিন্দ বাবু প্রতিনিধি নিৰ্বাচিত হইয়াছেন ৷ তােমাদের কনভেন্সন নির্ধারিত নিয়মানুসারে হুগলীর অধিবেশন হইতেছে না, যে কোন সভা যে কোন প্রতিনিধি নির্বাচন করিতে পারে ৷ ফলতঃ গুপ্তনীতি যেমন জঘন্য তেমনই নিষ্ফল ৷ কপটতার অভাব ইংরাজ-দিগের রাজনীতিক জীবনের একটা মহান গুণ; তাহারা যাহা করিতে হয় তাহা সাহসের সহিত সকলের সমক্ষে প্রকাশ্যভাবে, আৰ্য্যভাবে করে ৷ ভারতের রাজ-নীতিক জীবনে এই মহান গুণের অবতারণা করিতে হইবে ৷ চাণক্যনীতি রাজতন্ত্রে পােষায়, প্রজাতন্ত্রে কেবল ভীরুতা ও স্বাধীনতারক্ষণের অযােগ্যতা আনয়ন করে ৷
মরলীর ভেদনীতি
শাসন-সংস্কারের ছায়ায় যে ভেদনীতিবৃক্ষ উৎপন্ন হইয়াছে, লর্ড মরলী তাহা রােপণ করিয়াছেন, দেশহিতৈষী গােখলে মহাশয় জলসিঞ্চন করিয়া সযত্নে পালন করিতেছেন ৷ কলিকাতার ‘ইংলিশম্যান’ স্বীকার করিয়াছেন যে, ভেদনীতিই ভারতীয় সৈন্য সংগঠনের মূলতত্ত্ব ৷ ভেদনীতিই অনেক ইংরাজ রাজনীতিজ্ঞের মতে ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্য রক্ষার প্রধান উপায় ৷ লর্ড মরলীর নীতিও ভেদনীতি-প্রধান ৷ তাহার প্রথম চেষ্টা, মধ্যপন্থী দলকে রাজপুরুষদিগের হস্তগত করিয়া ও জাতীয় দলকে দলন করিয়া ভারতের নবােখান বিনষ্ট বা স্থগিত করিবার বিফল প্রয়াস ৷ সুরাট অধিবেশনের সময় এই বিষবৃক্ষ রােপিত হইয়াছিল ৷ বােম্বাইয়ের নেতাগণ ভারতবাসীর ভবিষ্যৎ, শক্তি বা ন্যায্য অধিকার সম্বন্ধে কখনও উদার মত বা উচ্চ আকাঙ্ক্ষা পােষণ করেন নাই ৷ তাহারা অতি অল্পে সন্তুষ্ট হইতেন ৷ বঙ্গদেশের উত্থান ও বয়কট প্রচারের প্রভাবে তাহাদের আশাতীত শাসন-সংস্কার হইয়াছে ৷ তাহারা সেই নবােথানের ফল স্বায়ত্ত করিয়া বয়কট ও বৈধ প্রতিরােধ বিনষ্ট করিবার জন্য অতিশয় ব্যগ্র হইয়াছেন ৷ সুরাট অধিবেশনের পূৰ্ব্বে এই সংস্কারের সম্ভাবনা তাহাদের অবিদিত ছিল না, কিন্তু তাহারা জানিতেন যে বয়কট-বর্জন ও চরমপন্থী দলের বহিষ্কার করিতে না পারিলে এই সুস্বাদু ফল তাহাদের মুখবিবরে পতিত হইবে না ৷ এই দুই উদ্দেশ্যের উপর লক্ষ্য রাখিয়া নাগপুর হইতে সুরাটে মহাসভা আনীত হইয়াছিল এবং মহাসভার কার্যপ্রণালীর সংশােধন প্রস্তাব হইয়াছিল: উদ্দেশ্য – জাতীয় দল আপনি মহাসভা ত্যাগ করিতে বাধ্য হইবেন ৷ সভাপতি ডাক্তার রাসবিহারী ঘােষের বক্তৃতাও সেই উদ্দেশ্যে লিখিত হইয়াছিল ৷ মহামতি তিলক, শ্ৰীযুত অরবিন্দ ঘােষ প্রভৃতি জাতীয় দলের নেতাগণ এই গুপ্ত অভিসন্ধি অবগত হইয়া মহাসভার কর্তৃপক্ষীয়দিগের কাৰ্যে তীব্র প্রতিবাদ ও বয়কট-নীতি রক্ষার জন্যে চেষ্টা করিতেছিলেন ৷ সুরাটের তুমুলকাণ্ডে তাহাদের চেষ্টা ব্যর্থ হইল, সার ফেরােজ শাহ মেহতাই জয়ী হইলেন ৷ আত্মদোষ-ক্ষালনের সময়ে জাতীয় দলের নেতাগণ বােম্বাইয়ের মধ্যপন্থীদের বিরুদ্ধে এই অভিযােগ প্রকাশ্যভাবে ঘােষণা করিলেন ৷ কিন্তু মধ্যপন্থীচালিত অসংখ্য পত্রিকায় গালাগালির এমন ৷ রােল উঠিল যে, সত্যের ক্ষীণ ধ্বনি সেই কোলাহলে ভাসিয়া গেল ৷ এখন সকল দেশবাসীকে বলিতে পারি, মেহেতা-গােখলের কাৰ্য্যকলাপ দেখুন, বুঝুন আমরা ভ্রান্ত ছিলাম, কি মিথ্যা কথা বলিয়াছিলাম; না বাস্তবিক তাহাদের ওইরূপ উদ্দেশ্য ছিল ৷ এই ভেদনীতি বােম্বাইয়ের মধ্যপন্থীগণকে অনায়াসে উদভ্রান্ত করিল ৷ বঙ্গ-দেশের নেতাগণ সেই কুপথের পথিক হন নাই, তাহারা বয়কট-রক্ষা করিয়াছেন ৷ ৭ই আগষ্ট স্বয়ং শ্ৰীযুত ভূপেন্দ্রনাথ বসু রাজপুরুষদের মিনতি ও ভয় প্রদর্শন তেজের সহিত উপেক্ষা করিয়া বয়কট উৎসবের সভাপতি হইয়াছিলেন ৷ আবার ‘বেঙ্গলী’ পত্রিকায় বয়কট নাম প্রচার হইয়া আমাদের আনন্দ ও আশা উৎপাদন করিয়াছে ৷ যদি ঐক্য স্থাপন কখনও সম্ভব হয়, যদি মরলীর ভেদনীতি বিফল হয়, তাহা বঙ্গবাসীর ঐক্যপ্রিয়তা ও বয়কটে দৃঢ়তা দ্বারাই সাধিত হইবে ৷
বিষবৃক্ষের অপর শাখা
লর্ড মরলীর দ্বিতীয় চেষ্টা, রাজনীতিক্ষেত্রে মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়কে পৃথক করা ৷ ইহাই ভেদনীতির দ্বিতীয় অঙ্গ, শাসন সংস্কারের দ্বিতীয় বিষময় ফল ৷ এই সম্বন্ধে লর্ড মরলী গুপ্ত চেষ্টা করেন নাই, প্রকাশ্যেই ভেদনীতি অবলম্বন করিয়া মুসলমান ও হিন্দুর চিরশত্রুতার ব্যবস্থা করিতেছেন ৷ অথচ ব্যবস্থাপক সভায় নির্বাচিত প্রতিনিধির সংখ্যাবৃদ্ধিতে মধ্যপন্থী নেতাগণ এমন মুগ্ধ ও প্রলুব্ধ যে সেই অল্প লাভের আশায় এই মহান অনিষ্ট আলিঙ্গন করিতে অগ্রসর হইতেছেন ৷ গােখলে মহাশয় মুক্তকণ্ঠে এই ভেদনীতির প্রশংসা করিয়াছেন ৷ তাহার মতে লর্ড মরলী ভারতের পরিত্রাতা ৷ তঁাহার মতে মুসলমানদিগের পৃথক প্রতিনিধি নির্বাচন ন্যায্য ও যুক্তিসঙ্গত ৷ ইহাতে যে মুসলমান ও হিন্দুর রাজনীতিক জীবনের শক্তি স্বতন্ত্র ও পরস্পরবিরােধী হইয়া জাতীয় মহাসভার মূলতত্ত্ব ও ভারতের ভাবী ঐক্য ও শান্তি সম্পূর্ণ বিনষ্ট হইবে এই সত্য গােখলে মহাশয়ের ন্যায় লব্ধপ্রতিষ্ঠ রাজনীতিবিদের বুদ্ধির অগােচর হইতে পারে না ৷ তবে কোন্ নিগুঢ় রহস্যময় সূক্ষ্মনীতির বশে গােখলে মহাশয় এই ভেদনীতির সমর্থন করিতে সাহসী হইয়াছেন, তাহা তিনিই জানেন ৷ আমাদের পূজনীয় সুরেন্দ্রনাথ এই সম্বন্ধে বিপরীত মত প্রকাশ করিয়াছেন, অথচ দৃঢ়ভাবে এই শাসন সংস্কার রূপ মহান অনর্থের প্রতিবাদ করিতে পারেন নাই ৷ বরং বিলাতপ্রবাসে প্রথম অবস্থায় এই শাসন সংস্কারের অযথা ও অমূলক প্রশংসা করিয়াছিলেন ৷ এই সংস্কারে বঙ্গবাসীর লেশমাত্র আস্থা নাই ৷ যদি কয়েকজন বড় লােক এই নূতন শাসনপ্রণালীতে যােগদান করিবার লােভ ছাড়িতে না পারিয়া দেশের প্রকৃত হিত ভুলিয়া যান, তাহাতে দেশের কোন অকল্যাণ হইবার সম্ভাবনা নাই ৷ কিন্তু সুরেন্দ্রবাবুর ন্যায় সৰ্বজনপূজিত নেতা এই বিষবৃক্ষে জলসেচন করিলে দেশের নিতান্ত দৰ্ভাগ্য বঝিতে হইবে ৷ যাঁহারা এই সংস্কারে যােগদান করিবেন, তাহারা মরলীর ভেদনীতির সহায়, সাম্প্রদায়িক বিরােধের সৃষ্টিকর্তা ও ভারতভূমির ভবিষ্যৎ একতার বাধাস্বরূপ হইয়া উঠিবেন ৷ শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ এই ভ্রান্ত নীতি অনুসরণ করিতে কখনও সম্মত হইবেন না, ইহাই আমাদের আশা ৷
রিজের বিষোদগার
রিজ “নামক একটা লােক এদেশে সিভিলিয়ান ছিলেন ৷ এখন পার্লামেন্টের সভ্য ৷ ইনিই একবার ভারতীয় কৃষকের সুহৃদ সাজিয়া বিশেষ বুদ্ধির পরিচয় দিয়া বলিয়াছিলেন, ভারতে বাঘ মারিতে দেওয়া অকৰ্ত্তব্য, কারণ বাঘ মারিলে হরিণ বাড়ে – হরিণ শস্যহানি করে ৷ নির্বাসন সম্বন্ধে ইহার যুক্তিহীন বক্তৃতায় বিরক্ত হইয়া পার্লামেন্টের একজন সভ্য পরিহাসচ্ছলে ইহাকেই নির্বাসিত করিবার প্রস্তাব করিয়াছিলেন ৷ সংপ্রতি পার্লামেন্টে ভারতীয় বাজেটের আলােচনাকালে ইনি বলিয়াছেন, ভারতে কোনরূপ আন্দোলন বৈধ হইতে পারে না ৷ ভারতীয় সংবাদপত্রসমূহ যে ইংরাজবিদ্বেষপূর্ণ তাহাতে হঁহার সন্দেহমাত্র নাই ৷ ইনি বলিয়াছেন ঘােষ নামক একটা লােক (শ্রীযুক্ত অরবিন্দ ঘােষই হঁহার উদ্দিষ্ট) অতিকষ্টে কারাদণ্ড হইতে অব্যাহতি লাভ করিয়াছে; এখন সে যুবকদিগকে বলিতেছে, কারাক্লেশ যতটা ভয়াবহ মনে হয়, প্রকৃতপক্ষে ততটা ভয়াবহ নহে, সুতরাং তাহারা যেন কাপুরুষ হইয়া না যায় ৷ ভারত গবর্ণমেণ্ট অচিরে ইহাকে নির্বাসিত করুন ৷ এই উক্তিতে যে নীচতা স্বপ্রকাশ তাহার “উতাের দিবার” প্রবৃত্তি আমাদের নাই ৷ তারপর ইনি বলেন, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বয়কট ঘােষণা করিতেছেন ৷ যাঁহারা অবাধ বাণিজ্যনীতির সমর্থন করিয়া পার্লামেন্টের সভ্যপদ পাইয়াছেন, তঁাহারা কি জানেন না যে, বয়কটের অর্থ এই যে, ভারতে আর বিলাত হইতে জুতা ও বিয়ার মদ যাইতে পারিবে না? কি ভীষণ! ধিংড়ার মত যুবকগণ কিরূপে নষ্ট হয় তাহার কথায় রিজ বলেন, তাঁহার নিকট ‘শিখের বলিদান' নামক একখানা পুস্তক আছে ৷ উহার লেখিকা একজন নির্বাসিত ব্যক্তির কন্যা (শ্রদ্ধেয় শ্রীযুক্ত কৃষ্ণকুমার মিত্র মহাশয়ের কন্যা শ্রীমতী কুমুদিনী মিত্র) ৷ এই ব্যক্তি একখানা রাজদ্রোহী সংবাদপত্রের (সঞ্জীবনী’র) সম্পাদক ৷ সুরেন্দ্রনাথ প্রত্যেক বাঙ্গালী ছাত্রের হাতে এই পুস্তক দেখিতে ইচ্ছা করেন, বলিয়া ‘শিখের বলিদান’এর প্রশংসা করিয়াছেন ৷ রিজের বিদ্যাবদ্ধি আমাদের অপরিজ্ঞাত নহে ৷ তবে যে তাহার কথা বলিলাম, সে কেবল বিলাতে ভারত সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞদিগের বিদ্যার দৌড় দেখাইবার জন্য ৷ শিখের আত্মবলিদান মহিমা বুঝিবার সাধ্য রিজের মত লােকের নাই ৷ ভারতচন্দ্র সত্যই বলিয়াছেন – “পড়িলে ভেড়ার শৃঙ্গে ভাঙ্গে হীরার ধার ৷”
Home
Sri Aurobindo
Books
Bengali
Share your feedback. Help us improve. Or ask a question.