All writings in Bengali and Sanskrit including brief works written for the newspaper 'Dharma' and 'Karakahini' - reminiscences of detention in Alipore Jail.
All writings in Bengali and Sanskrit. Most of the pieces in Bengali were written by Sri Aurobindo in 1909 and 1910 for 'Dharma', a Calcutta weekly he edited at that time; the material consists chiefly of brief political, social and cultural works. His reminiscences of detention in Alipore Jail for one year ('Tales of Prison Life') are also included. There is also some correspondence with Bengali disciples living in his ashram. The Sanskrit works deal largely with philosophical and cultural themes. (This volume will be available both in the original languages and in a separate volume of English translations.)
c/o K. B. Jadhav, Esq. Near Municipal Office Baroda 25th June 1902
প্রিয়তমা মৃণালিনী,
তােমার জ্বরের কথা শুনে বড় দুঃখিত হলাম ৷ আশা করি এর পরে তুমি তােমার শরীর একটু দেখবে ৷ ঠাণ্ডা জায়গা, যাতে ঠাণ্ডা না লাগে, তাই করিবে ৷ আজ দশ টাকা পাঠালাম, ঔষধ আনিয়ে রােজ খাবে, অন্যথা করিবে না ৷ আমি একটা ঔষধের সন্ধান পেয়েছি যাতে তােমার অসুখ সারিবে ৷ রােজ খেতে হবে না, দুয়েকবার খেলেই সারিবে কিন্তু আসামে খাবার সুবিধে হবে না ৷ দেওঘরে গেলে খেতে পারিবে ৷ আমি সরােজিনীকে লিখব কি করিতে হবে ৷
সরােজিনী দেওঘরেই আছে ৷ বৌদিদি দার্জিলিং থেকে কলিকাতায় গিয়েছেন, দার্জিলিঙে খ করে ৷ সরােজিনী চিঠি লিখেছে, শীতকাল পর্যন্ত দেশে থাকবে ৷ দিদিমারা তাকে খুব ধরেছেন, ওঁদের আশা বৌদিদি সরােজিনীর বিয়ে যােগাড় করিতে পারিবেন ৷ আমার মতে বেশী আশা নেই ৷ তবে যদি সরােজিনী রূপগুণের অতিরিক্ত আশা ছাড়ে, হলেই হয় ৷
কেঁচো লানাবলী পাহাড়ে গিয়েছিল, আমাকেও সেখানে ডেকেছিল ৷ প্রবন্ধ লিখবার ইচ্ছা ছিল, তাই বলে ডেকেছিল ৷ লেখাও হল কিন্তু বের করিবে না ৷ শেষমুহুর্তে কি হল, হঠাৎ মত ফিরল ৷ আর একটা খুব মহৎ আর গােপনীয় ৷ কাজ যুটল, আমাকেই করিতে হইল ৷ আমার কাজ দেখে কেঁচো বড়ই সন্তুষ্ট হল আবার প্রতিজ্ঞা করেছে আমার বেশী মাইনে দেবে ৷ কে জানে দেবে কি না ৷ কেঁচোর কথার কথাই সার, কাজ ত বড় দেখা যায় না ৷ তবে দিতে পারে ৷ যা দেখতে পাচ্চি তাতে বােধ হচ্চে যে কেঁচোর পতনের দিন ঘনিয়ে আসছে, সব লক্ষণ খারাপ ৷
আমি এখন খাসেরাওদের বাড়ীতেই আছি, তােমরা আসবে তখন নৌলাখীতে যাইব ৷ এ বৎসর বৃষ্টি বােধ হয় বেশী পড়বে না ৷ বৃষ্টি না পড়লে নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ হবে ৷ তা হলে তােমার এখানে আসা বন্ধ হতে পারে, এলে কেবলি কষ্ট হবে, খাবার কষ্ট, জলের কষ্ট, গরমের কষ্ট ৷ বরদায় এ বৎসর গৰ্মী পড়েনি, বড় সুন্দর বাতাস বয়ে রয়েছে, কিন্তু সে সুন্দর বাতাসে বৃষ্টির আশা উড়ে যাচ্ছে ৷ এখনাে দশ বার দিন আছে, সেই দশ বার দিনের মধ্যে ভাল বৃষ্টি হলে, এই মহাবিপদের হাত থেকে উদ্ধার হবে ৷ দেখি অদৃষ্টে কি লেখা আছে ৷
তােমার ছবি শীঘ্রই পাঠাব ৷ যতীন্দ্র ব্যানার্জী আমাদের বাড়ীতে রয়েছে, আজ দেখা করিতে যাইব, ভাল ছবি বেছে নেব ৷
তােমার বাপ আর তােমার মাকে আমার প্রণাম জানাবে ৷ আর সব না লিখলেও তুমি বুঝে নেবে ৷
তােমার স্বামী
30th August 1905
তােমার 24th Augustএর পত্র পাইলাম ৷ তােমার বাপ-মার আবার সেই দুঃখ হইয়াছে শুনিয়া দুঃখিত হইলাম ৷ কোন্ ছেলেটী পরলােক গিয়াছে, তাহা তুমি লিখ নাই ৷ দুঃখ হলে বা কি হয় ৷ সংসারে সুখের অন্বেষণে গেলেই সেই সুখের মধ্যেই দুঃখ দেখা দেয়, দুঃখ সৰ্ব্বদা সুখকে জড়াইয়া থাকে, এই নিয়ম যে পুত্র কামনার সম্বন্ধেই খাটে তাহা নহে, সব সাংসারিক কামনার ফল এই ৷ ধীর চিত্তে সব সুখদুঃখ ভগবানের চরণে অর্পণ করাই মানুষের একমাত্র উপায় ৷
আমি কুড়ি টাকা না পড়িয়া দশ টাকা পড়িয়াছিলাম, তাই দশ টাকা পাঠাইব বলিয়াছিলাম ৷ পনের টাকা যদি দরকার পনের টাকাই পাঠাইব ৷ এই মাসে সরােজিনী তােমার জন্যে দার্জিলিঙে কাপড় কিনিয়াছে, তার টাকা পাঠাইয়াছি ৷ তুমি যে এইদিকে ধার করিয়া বসেছ, তাহা কি করিয়া জানিব? পনের টাকা লেগেছিল, পাঠাইয়াছি, আর তিন চারি টাকা লাগিবে, তাহা আগামী মাসে পাঠাইব ৷ তােমাকে এইবার কুড়ি টাকা পাঠাইব ৷
এখন সেই কথাটী বলি ৷ তুমি বােধ হয় এর মধ্যে টের পেয়েছ, যাহার ভাগ্যের সঙ্গে তােমার ভাগ্য জড়িত, সে বড় বিচিত্র ধরণের লােক ৷ এই দেশে আজকালকার লােকের যেমন মনের ভাব, জীবনের উদ্দেশ্য, কৰ্ম্মের ক্ষেত্র, আমার কিন্তু তেমন নয়; সব বিষয়েই ভিন্ন, অসাধারণ ৷ সামান্য লােকে অসাধারণ মত, অসাধারণ চেষ্টা, অসাধারণ উচ্চ আশাকে যাহা বলে তাহা বােধ হয় তুমি জান ৷ এই সকল ভাবকে পাগলামি বলে, তবে পাগলের কর্মক্ষেত্রে সফলতা হইলে ওকে পাগল না বলিয়া প্রতিভাবান মহাপুরুষ বলে ৷ কিন্তু ক’জনের চেষ্টা সফল হয়? সহস্র লােকের মধ্যে দশ জন অসাধারণ, সেই দশ জনের মধ্যে একজন কৃতকার্য হয় ৷ আমার কর্মক্ষেত্রে সফলতা দূরের কথা, সম্পূর্ণভাবে কর্মক্ষেত্রে অবতরণও করিতে পারি নাই, অতএব আমাকে পাগলই বুঝিবে ৷ পাগলের হাতে পড়া স্ত্রীলােকের পক্ষে বড় অমঙ্গল, কারণ স্ত্রীজাতির সব আশা সাংসারিক সুখদুঃখেই আবদ্ধ ৷ পাগল তাহার স্ত্রীকে সুখ দিবে না, দুঃখই দেয় ৷
হিন্দুধর্মের প্রণেতৃগণ ইহা বুঝিতে পারিয়াছিলেন ৷ তাঁহারা অসামান্য চরিত্র চেষ্টা ও আশাকে বড় ভালবাসিতেন, পাগল হৌক বা মহাপুরুষ হৌক অসাধারণ লােককে বড় মানিতেন ৷ কিন্তু এ সকলেতে স্ত্রীর যে ভয়ঙ্কর দুর্দশা হয়, তাহার কি উপায় হইবে? ঋষিগণ এই উপায় ঠিক করিলেন, তাঁহারা স্ত্রীজাতিকে বলিলেন, তােমরা অদ্য হইতে পতিঃ পরমাে গুরুঃ, এই মন্ত্রই স্ত্রীজাতির একমাত্র মন্ত্র বুঝিবে ৷ স্ত্রী স্বামীর সহধর্মিণী, তিনি যে কাৰ্য্যই স্বধৰ্ম্ম বলিয়া গ্রহণ করিবেন, তাহাতে সাহায্য দিবে, মন্ত্রণা দিবে, উৎসাহ দিবে, তঁহাকে দেবতা বলিয়া মানিবে, তাহারই সুখে সুখ, তাহারই দুঃখে দুঃখ করিবে ৷ কার্য নির্বাচন করা পুরুষের অধিকার, সাহায্য ও উৎসাহ দেওয়া স্ত্রীর অধিকার ৷
এখন কথাটা এই, তুমি হিন্দুধর্মের পথ ধরিবে না নূতন সভ্য ধর্মের পথ ধরিবে? পাগলকে বিবাহ করিয়াছ, সে তােমার পূর্বজন্মাৰ্জিত কৰ্ম্মদোষের ফল ৷ নিজের ভাগ্যের সঙ্গে একটা বন্দোবস্ত করা ভাল, সে কি রকম বন্দোবস্ত হইবে? পাঁচ জনের মতের আশ্রয় লইয়া তুমিও কি ওকে পাগল বলিয়া উড়াইয়া দিবে? পাগল ত পাগলামির পথে ছুটিবেই ছুটিবে, তুমি ওকে ধরিয়া রাখিতে পারিবে , তােমার চেয়ে ওর স্বভাবই বলবান ৷ তবে তুমি কি কোণে বসিয়া কাদিবে মাত্র, না তার সঙ্গেই ছুটিবে, পাগলের উপযুক্ত পালী হইবার চেষ্টা করিবে ৷ যেমন অন্ধরাজার মহিষী চক্ষুদ্বয়ে বস্ত্র বাঁধিয়া নিজেই অন্ধ সাজিলেন ৷ হাজার ব্রাহ্মস্কুলে পড়িয়া থাক তবু তুমি হিন্দু ঘরের মেয়ে, হিন্দু পূর্বপুরুষের রক্ত তােমার শরীরে, আমার সন্দেহ নাই তুমি শেষােক্ত পথই ধরিবে ৷
আমার তিনটী পাগলামি আছে ৷ প্রথম পাগলামি এই, আমার দৃঢ় বিশ্বাস ভগবান যে গুণ, যে প্রতিভা, যে উচ্চশিক্ষা ও বিদ্যা, যে ধন দিয়াছেন, সবই ভগবানের, যাহা পরিবারের ভরণপােষণে লাগে আর যাহা নিতান্ত আবশ্যকীয়, তাহাই নিজের জন্যে খরচ করিবার অধিকার, যাহা বাকী রইল, ভগবানকে ফেরত দেওয়া উচিত ৷ আমি যদি সবই নিজের জন্যে, সুখের জন্যে, বিলাসের জন্যে খরচ করি, তাহা হইলে আমি চোর ৷ হিন্দুশাস্ত্রে বলে, যে ভগবানের নিকট ধন লইয়া ভগবানকে দেয় না, সে চোর ৷ এ পর্যন্ত ভগবানকে দুই আনা দিয়া চৌদ্দ আনা নিজের সুখে খরচ করিয়া হিসাবটা চুকাইয়া সাংসারিক সুখে মত্ত রহিয়াছি ৷ জীবনের অর্ধাংশটা বৃথা গেল, পশুও নিজের ও নিজের পরিবারের উদর পূরিয়া সুখ করিয়া কৃতার্থ হয় ৷ আমি এতদিন পশুবৃত্তি ও চৌর্যবৃত্তি করিয়া আসিতেছি ইহা বুঝিতে পারিলাম ৷ বুঝিয়া বড় অনুতাপ ও নিজের উপর ঘৃণা হইয়াছে ৷ আর নয়, সে পাপ জন্মের মতন ছাড়িয়া দিলাম ৷
ভগবানকে দেওয়ার মানে কি ৷ মানে ধৰ্ম্মকাৰ্যে ব্যয় করা ৷ যে টাকা সরােজিনী বা উষাকে দিয়াছি তার জন্যে কোন অনুতাপ নাই, পরােপকার ধৰ্ম্ম, আশ্রিতকে রক্ষা করা মহাধর্ম ৷ কিন্তু শুধু ভাইবােনকে দিলে হিসাবটা চুকে না ৷ এই দুর্দিনে সমস্ত দেশ আমার দ্বারে আশ্রিত, আমার ত্রিশকোটী ভাই-বােন এই দেশে আছে, তাহাদের মধ্যে অনেক অনাহারে মরিতেছে, অধিকাংশই কষ্টে ও দুঃখে জর্জরিত হইয়া কোনমতে বাঁচিয়া থাকে ৷ তাহাদেরও হিত করিতে হয় ৷
কি বল, এই বিষয়ে আমার সহধর্মিণী হইবে? কেবল সামান্য লােকের মত খাইয়া পরিয়া যাহা সত্যি সত্যি দরকার তাহাই কিনিয়া আর সব ভগবানকে দিব, এই আমার ইচ্ছা ৷ তুমি মত দিলেই, ত্যাগ স্বীকার করিতে পারিলেই আমার অভিসন্ধি পূর্ণ হইতে পারে ৷ তুমি বছিলে “আমার কোন উন্নতি হল না ৷” এই একটা উন্নতির পথ দেখাইয়া দিলাম, সে পথে যাইবে কি?
দ্বিতীয় পাগলামি সম্প্রতিই ঘাড়ে চেপেছে ৷ পাগলামিটা এই, যে কোনমতে ভগবানের সাক্ষাদ্দর্শন লাভ করিতে হইবে ৷ আজকালকার ধৰ্ম্ম, ভগবানের নাম কথায় কথায় মুখে নেওয়া, সকলের সমক্ষে প্রার্থনা করা, লােককে দেখান আমি কি ধাৰ্ম্মিক! তাহা আমি চাই না ৷ ঈশ্বর যদি থাকেন, তাহা হইলে তাহার অস্তিত্ব অনুভব করিবার, তাহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিবার কোন-না-কোন পথ থাকিবে ৷ সে পথ যতই দুর্গম হােক আমি সে পথে যাইবার দৃঢ় সঙ্কল্প করিয়া বসিয়াছি ৷ হিন্দুধৰ্ম্মে বলে, নিজের শরীরের নিজের মনের মধ্যে সেই পথ আছে ৷ যাইবার নিয়ম দেখাইয়া দিয়াছে – আমি সেই সকল পালন করিতে আরম্ভ করিয়াছি, এক মাসের মধ্যে অনুভব করিতে পারিলাম, হিন্দুধর্মের কথা মিথ্যা নয়, যে-যে চিহ্নের কথা বলিয়াছে সেই সব উপলব্ধি করিতেছি ৷ এখন আমার ইচ্ছা তােমাকেও সেই পথে নিয়া যাই, ঠিক সঙ্গে সঙ্গে যাইতে পারিবে না, কারণ তােমার অত জ্ঞান হয় নাই, কিন্তু আমার পিছনে পিছনে আসিতে কোন বাধা নাই, সে পথে সিদ্ধি সকলের হইতে পারে, কিন্তু প্রবেশ করা ইচ্ছার উপর নির্ভর করে, কেহ তােমাকে ধরিয়া নিয়া যাইতে পারিবে না, যদি মত থাকে তবে ইহার সম্বন্ধে আরও লিখিব ৷
তৃতীয় পাগলামি এই যে, অন্য লােকে স্বদেশকে একটা জড় পদার্থ, কতগুলাে মাঠ ক্ষেত্র বন পৰ্বত নদী বলিয়া জানে; আমি স্বদেশকে মা বলিয়া জানি, ভক্তি করি, পূজা করি ৷ মার বুকের উপর বসিয়া যদি একটা রাক্ষস রক্তপানে উদ্যত হয়, তাহা হইলে ছেলে কি করে? নিশ্চিন্তভাবে আহার করিতে বসে, স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে আমােদ করিতে বসে, না মাকে উদ্ধার করিতে দৌড়াইয়া যায়? আমি জানি, এই পতিত জাতিকে উদ্ধার করিবার বল আমার গায়ে আছে ৷ শারীরিক বল নাই, তরবারি বা বন্দুক নিয়া আমি যুদ্ধ করিতে যাইতেছি না, জ্ঞানের বল ৷ ক্ষত্ৰতেজ একমাত্র তেজ নহে, ব্রহ্মতেজও আছে, সেই তেজ জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত ৷ এই ভাব নূতন নহে, আজকালকার নহে, এই ভাব নিয়া আমি জন্মিয়াছিলাম, এই ভাব আমার মজ্জাগত ৷ ভগবান এই মহাব্রত সাধন করিতে আমাকে পৃথিবীতে পাঠাইয়াছিলেন ৷ চৌদ্দ বৎসর বয়সে বীজটা অঙ্কুরিত হইতে লাগিল, আঠার বৎসর বয়সে প্রতিজ্ঞা দৃঢ় ও অচল হইয়াছিল ৷ তুমি নমাসীর কথা শুনিয়া ভাবিয়াছিলে কোথাকার বদলােকে আমার সরল ভালমানুষ স্বামীকে কুপথে টানিয়া লইয়াছে ৷ তােমার ভালমানুষ স্বামীই কিন্তু সেই লােককে ও আর শত শত লােককে সেই পথে, কুপথ হােক বা সুপথ হােক, প্রবেশ করাইয়াছিল, আরও সহস্র সহস্র লােককে প্রবেশ করাইবেন ৷ কার্যসিদ্ধি আমি থাকিতেই হইবে তাহা আমি বলিতেছি না, কিন্তু হইবে নিশ্চয়ই ৷
এখন বলি তুমি এ বিষয়ে কি করিতে চাও? স্ত্রী স্বামীর শক্তি ৷ তুমি উষার শিষ্য হইয়া সাহেবপূজামন্ত্র জপ করিবে? উদাসীন হইয়া স্বামীর শক্তি খর্ব করিবে? না সহানুভূতি ও উৎসাহ দিয়া দ্বিগুণিত করিবে? তুমি বলিবে, এই সব মহৎ কর্মে আমার মত সামান্য মেয়ে কি করিতে পারে, আমার মনের বল নাই, বুদ্ধি নাই, ওই সব কথা ভাবিতে ভয় করে ৷ তাহার সহজ উপায় আছে, – ভগবানের আশ্রয় নাও, ঈশ্বরপ্রাপ্তির পথে একবার প্রবেশ কর, তােমার যে-যে অভাব আছে তিনিই শীঘ্র পূরণ করিবেন ৷ যে ভগবানের নিকটে আশ্রয় লইয়াছে, ভয় তাহাকে ক্রমে ক্রমে ছাড়িয়া দেয় ৷ আর আমার উপর যদি বিশ্বাস করিতে পার, দশ জনের কথা না শুনিয়া আমারই কথা যদি শােন, আমি তােমাকে আমারই বল দিতে পারি, তাহাতে আমার বলের হানি না হইয়া বৃদ্ধি হইবে ৷ আবার বলি স্ত্রী স্বামীর শক্তি, মানে, স্বামী স্ত্রীর মধ্যে নিজের প্রতিমূর্তি দেখিয়া তাহার কাছে নিজের মহৎ আকাঙক্ষার প্রতিধ্বনি পাইয়া দ্বিগুণ শক্তি লাভ করে ৷
চিরদিন কি এই ভাবে থাকিবে? আমি ভাল কাপড় পরিব, ভাল আহার খাইব, হাসিব, নাচিব, যত রকম সুখ ভােগ করিব, এই মনের অবস্থাকে উন্নতি বলে না ৷ আজকাল আমাদের দেশের মেয়েদের জীবন এই সঙ্কীর্ণ ও অতি হেয় আকার ধারণ করিয়াছে ৷ তুমি এই সব ছেড়ে দাও, আমার সঙ্গে এস, জগতে ভগবানের কাজ করিতে আসিয়াছি, সেই কাজ আরম্ভ করি ৷
তােমার স্বভাবের একটা দোষ আছে, তুমি অতিমাত্র সরল ৷ যে যাহা বলে, তাহাই শােন ৷ ইহাতে মন চিরকাল অস্থির থাকে, বুদ্ধি বিকাশ পায় না, কোন কর্মে একাগ্রতা হয় না ৷ এটা শুধরােতে হইবে, একজনেরই কথা শুনিয়া জ্ঞান সঞ্চয় করিতে হইবে, এক লক্ষ্য করিয়া অবিচলিত চিত্তে কাৰ্য্য সাধন করিতে হইবে, লােকের নিন্দা ও বিদ্রপকে তুচ্ছ করিয়া স্থির ভক্তি রাখিতে হইবে ৷
আর একটা দোষ আছে, তােমার স্বভাবের নয়, কালের দোষ ৷ বঙ্গদেশে কাল অমনতর হইয়াছে ৷ লােকে গম্ভীর কথাও গম্ভীর ভাবে শুনিতে পারে না; ধর্ম, পরােপকার, মহৎ আকাঙক্ষা, মহৎ চেষ্টা, দেশােদ্ধার, যাহা গম্ভীর, যাহা উচ্চ ও মহৎ, সব নিয়ে হাসি ও বিদ্রপ, সবই হাসিয়া উড়াইতে চায়; ব্রাহ্মস্কুলে থেকে থেকে তােমার এই দোষ একটু একটু হইয়াছে, বারিরও ছিল, অল্প পরিমাণে আমরা সকলেই এই দোষে দূষিত, দেওঘরের লােকের মধ্যে ত আশ্চৰ্য্য বৃদ্ধি পাইয়াছে ৷ এই মনের ভাব দৃঢ় মনে তাড়াইতে হয়, তুমি তাহা সহজে পারিবে, আর একবার চিন্তা করিবার অভ্যাস করিলে, তােমার আসল স্বভাব ফুটিবে; পরােপকার ও স্বার্থত্যাগের দিকে তােমার স্বাভাবিক টান আছে, কেবলি এক মনের জোরের অভাব, ঈশ্বর-উপাসনায় সেই জোর পাইবে ৷
এটাই ছিল আমার সেই গুপ্ত কথা ৷ কারুর কাছে প্রকাশ না করিয়া নিজের মনে ধীরচিত্তে এই সব চিন্তা কর, এতে ভয় করিবার কিছু নাই, তবে চিন্তা করিবার অনেক জিনিষ আছে ৷ প্রথমে আর কিছু করিতে হইবে না, কেবল রােজ আধ ঘণ্টা ভগবানকে ধ্যান করিতে হয়, তাঁর কাছে প্রার্থনারূপে বলবতী ইচ্ছা প্রকাশ করিতে হয় ৷ মন ক্রমে ক্রমে তৈয়ারী হইবে ৷ তার কাছে সৰ্ব্বদা এই প্রার্থনা করিতে হয়, আমি যেন স্বামীর জীবন, উদ্দেশ্য ও ঈশ্বরপ্রাপ্তির পথে ব্যাঘাত না করিয়া সৰ্ব্বদা সহায় হই, সাধনভূত হই ৷ এটা করিবে?
তােমার
3 Oct. 1905
প্রিয়তমা,
এই পনের দিন কলেজের পরীক্ষা চলিতেছে, তাহা ছাড়া একটী স্বদেশী সমিতি স্থাপন হইতেছে, এই দুই কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম বলিয়া চিঠি লিখিবার অবসর পাই নাই ৷ তােমারও চিঠি অনেকদিন পাই নাই ৷ আশা করি তােমরা সকলে ভাল আছ ৷ কাল থেকে কলেজ বন্ধ ৷ অবশ্যই আমার কাজ বন্ধ নয়, তবে একঘণ্টার বেশী করিতে হয় না ৷
আমি এইবারে কুড়ি টাকা পাঠাইলাম ৷ দশটাকা Burn Company কেরানীদের জন্য দিতে পার ৷ তা নৈলে আর কোনও সদুদ্দেশে খরচ কর ৷Burn Companyর ব্যাপারটা কি আমি বুঝিতে পারি না, খবরের কাগজে কোন স্পষ্ট বর্ণনা পাই নাই ৷ আজকাল এইরকম ধৰ্ম্মঘট করা সহজ ব্যাপার নয়, গরীব প্রায়ই হার খায়, ধনবানের জয় হয় ৷ যেদিন ভারতবাসী মধ্যমশ্রেণীর লােক ক্ষুদ্র চাকরীর আশা ছাড়িয়া নিজে ব্যবসা করিতে যাইবে, সে ভারতের বড় সুদিন হইবে ৷ বেশী টাকা দিতে পারি না, কারণ সরােজিনীকে তার দার্জিলিঙের খরচের জন্যে 60 বা 70 টাকা দিতে হইবে, আর মাধবরাওকে বিলেতে কোন বিশেষ কাজের জন্যে পাঠান হয়েছে, তার জন্যেও টাকা রাখিতে হয় ৷ স্বদেশী movementএর জন্যে অনেক টাকা দিতে হইয়াছে, তার উপর আর একটী movement চালাইবার চেষ্টা করিতেছি তার জন্যে অশেষ টাকা চাই ৷ আমার কিছু বাঁচছে না ৷
Florilineটা পাঠান হল, আশা করি পেয়েছ ৷ ধনজী এখানে ছিল না, তার পরে এসেছে কিন্তু লক্ষণরাও পরীক্ষায় ব্যস্ত, আমারও সেই দশা, দুজনে ভুলিয়া গিয়াছিলুম ৷ শীঘ্র prescription পাঠাইব ৷
“Seeker” পড়িবে কেন? সে ত পুরােন কবিতা, ধৰ্ম্মের সম্বন্ধে আমার তখন কোনও জ্ঞান ছিল না ৷ কবিতাটা অতিমাত্র pessimistic. বাঙ্গালায় pessimis-tic কি জানি না, মারাঠীতে নিরাশাবাদী বলে ৷ এখন আমি বুঝিতে পারিলাম নিরাশা অজ্ঞানের একটা রূপ মাত্র ৷
সেদিন খাসেরাও এর কাছে গিয়েছিলাম ৷ আনন্দরাও খুব মস্ত হয়েছে ৷ বড় জোচ্ছাের হবে ৷
শ্রী
22 Oct. 1905
তােমার পত্র পাইলাম ৷ অনেকদিন চিঠি লিখিনি কিছু মনে করিবে না ৷ আমার health নিয়ে অত চিন্তা কেন, আমার ত কখন সর্দি কাশি ছাড়া কোন ব্যামাে হয় না ৷ বারি এখানে আছে, তাহার শরীর ভয়ানক খারাপ, কেবলি জ্বরের ফলে নানা রােগ হয়, কিন্তু হাজার রােগ হলেও তাহার তেজ কমে না, স্থির থাকে না, একটু ভাল হলেই দেশের কাজে বেরুতে চায় ৷ সে চাকরী নেবে না ৷ অবশ্যই এসব খবর সরােজিনীকে লিখি না; তুমিও লেখাে না, সে ভাবনায় পাগল হবে, বােধ হয় নভেম্বর মাসে কলিকাতায় যাব, সেখানে আমার অনেক কাজ আছে ৷
তােমার সেই লম্বা চিঠি পেয়ে আমার নিরাশ হবার কোন কারণ হয়নি, আনন্দিতই হয়েছিলাম ৷ সরােজিনী ত্যাগ স্বীকার করিতে তােমার মত প্রস্তুত হলে আমার ভবিষ্যতে কাজের বড় সুবিধে হয় ৷ তাহা কিন্তু হবে না ৷ তাহার সুখের আশা অতি প্রবল, জানি না কখন জয় করিতে পারিবে কি না ৷ ভগবানের যা ইচ্ছে তাহাই হবে ৷
তােমার চিঠি একটা কাগজের জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গেছে, বের করব ৷ পেলেই আবার লিখব ৷ সন্ধ্যার সময় হচ্চে, আজকের মতন শেষ করি ৷
আমি ভাল আছি, চিঠি না পেলেও চিন্তা করিতে নাই ৷ আমার কি অসুখ হবে? আশা করি তােমরা সব ভাল আছ ৷
আমার নাম নিয়ে কি করিবে? ওই dash বসিয়েছি, তাহা চলিবে না?
c/o Babu Subodh Chandra Mullick 12 Wellington Square Calcutta
[December 1905?]
তােমার একখানি চিঠি পাইয়াছি ৷ তাহা পড়িয়া দুঃখিত হইলাম ৷ আমি বম্বে হইতে তােমাকে একটী চিঠি লিখিয়াছিলাম, সেই চিঠিতে আমার দেশে যাবার অভিপ্রায় জানাইয়াছিলাম ৷ তার সঙ্গে অনেক দরকারী কথা ছিল ৷ আর কাহাকেও দেশে যাবার কথা জানাই নাই ৷ না জানাইবার বিশেষ কারণও ছিল ৷ এখন বুঝিতে পারিলাম সেই চিঠি পাও নাই ৷ হয় চাকর পােষ্টে দেয় নি, নয় পােষ্ট অফিসে গােলমাল করিয়াছে ৷ যা হৌক তুমি যে অত সহজে ধৈৰ্য্যচ্যুত হও, এটা বড় দুঃখের কথা ৷ কেননা – আবার সেই কথা বলি – তুমি একজন সাধারণ সাংসারিক লােকের স্ত্রী হও নাই, তােমার বিশেষ ধৈৰ্য্য ও শক্ততার দরকার ৷ এমন সময়ও আসিতে পারে যখন একমাস কিংবা দেড়মাস নয়, ছমাস পর্যন্তও আমার কোন খবর পাইবে না ৷ এখন থেকে একটু শক্ত হইতে শিখিতে হয়, তাহা না হইলে ভবিষ্যতে অশেষ দুঃখ ভােগ করিতে হইবে ৷
অনেক দরকারী কথা লিখিয়াছিলাম, সে সব আবার লিখিবার সময় নাই ৷ একটু পরে লিখিব ৷ আমি এখান থেকে শীঘ্র কাশী যাব, কাশী হইতে বরদা ৷ গেলেই ছুটি নিয়ে আবার দেশে আসিব ৷ তবে যদি Clarke না আসিয়া থাকেন, একটু মুস্কিল হবে ৷
বারি দেওঘরে রয়েছে, তার কেবলি জ্বর হয় ৷ আমি ছুটি না পাইলে সে বােধ হয় বরদায় ফিরিয়া যাইবে ৷
A.G.
2nd March 1906
আজ কলিকাতায় যাত্রা করিব ৷ অনেক দিন আগে যাইবার কথা ছিল, কিন্তু ছুটির হুকুম হইয়া গেলেও বরদার কর্তারা সহি করিবার সময় পান নাই বলিয়া আমার দশদিন বৃথাই গেল ৷ যাই হােক সােমবারে কলিকাতায় পহুচিব ৷ কোথায় থাকিব জানি নাই ৷ নমাসীর বাড়িতে থাকিবার যাে নাই ৷ একে আমি মাছ মাংস ছাড়িয়া দিয়াছি, আর এই জীবনে বােধহয় খাইব না, কিন্তু নমাসী তাহা শুনিবেন কেন ৷ তারপর আমার একান্ত জায়গা না থাকিলে সুবিধা নাই ৷ সকালে দেঢ়ঘণ্টা আর সন্ধ্যাবেলা দেড়ঘণ্টা একেলা বসিয়া কত কি করিতে হয়, সেসব পরের সম্মুখে হয় না ৷ 12 Wellington Squareএ আমার বেশ সুবিধা হইত, কিন্তু হেম মল্লিক সম্প্রতি মারা গেলেন, সেইখানে এখন যাইতে পারিব না ৷ তবে সেই ঠিকানায় চিঠি লিখিলে আমি পাইব ৷
আসামে যেতে বলেছ, চেষ্টা করিব ৷ কিন্তু একবার কলিকাতায় পদার্পণ করিলে কেউ ছাড়ে না ৷ হাজার কাজ হাতে আসে, আত্মীয়দের কাছে দেখা করিতে যাইবার সময় পাই না ৷ আর আসামে গেলে দুচারদিনই থাকিতে পারিব ৷ তােমাকে বারি বেশ আনিতে পারে, তার সঙ্গে রণছােড়কে দিতে পারি ৷ আমি যদি যাই, এ মাসে বােধ হয় পেরে উঠিব না, তবে কলিকাতায় গিয়ে দেখি ৷ এটাও হতে পারে, সরােজিনী যদি আসামে যেতে চায়, বারি দিয়ে দিতে পারে, আমি এক মাস পরে গিয়ে আনিতে পারি ৷ কলিকাতায় গিয়ে ঠিক করিব ৷
শ্রীঅরবিন্দ ঘােষ
23 Scott's Lane Calcutta 17th February, 1907.1
প্রিয় মৃণালিনী,
অনেক দিন চিঠি লিখি নাই, সেই আমার চিরন্তন অপরাধ, তাহার জন্য তুমি নিজ গুণে ক্ষমা না করিলে, আমার আর উপায় কি? যাহা মজ্জাগত তাহা এক দিনে বেরােয় না, এই দোষ শুধরাইতে আমার বােধ হয় এই জন্ম কাটিবে ৷
8th জানুয়ারি আসিবার কথা ছিল, আসিতে পারি নাই, সে আমার ইচ্ছায় ঘটে নাই ৷ যেখানে ভগবান নিয়া গিয়াছেন সেইখানে যাইতে হইল ৷ এইবার আমি নিজের কাজে যাই নাই, তাহারই কাজে গিয়াছিলাম ৷ আমার এইবার মনের অবস্থা অন্যরূপ হইয়াছে, সে কথা এই পত্রে প্রকাশ করি এখানে এস, তখন যাহা বলিবার আছে, তাহা বলিব ৷ কেবল এই কথাই এখন বলিতে হইল, যে এর পরে আমি আর নিজের ইচ্ছাধীন নই, যেইখানে ভগবান ৷ আমাকে নিয়া যাইবেন সেইখানে পুতুলের মত যাইতে হইবে, যাহা করাইবেন ৷ তাহা পুতুলের মত করিতে হইবে ৷ এখন এই কথার অর্থ বােঝা তােমার পক্ষে কঠিন হইবে, তবে বলা আবশ্যক নচেৎ আমার গতিবিধি তােমার আক্ষেপ ও দুঃখের কথা হইতে পারে ৷ তুমি মনে করিবে আমি তােমাকে উপেক্ষা করিয়া কাজ করিতেছি ৷ তাহা মনে করিবে না ৷ এই পৰ্য্যন্ত আমি তােমার বিরুদ্ধে অনেক দোষ করিয়াছি, তুমি যে তাহাতে অসন্তুষ্ট হইয়াছিলে, সে স্বাভাবিক কিন্তু এখন আমার আর স্বাধীনতা নাই, এর পরে তােমাকে বুঝিতে হইবে যে আমার সব কাজ আমার ইচ্ছার উপর নির্ভর না করিয়া ভগবানের আদেশেই হইল ৷ তুমি আসিবে, তখন আমার কথার তাৎপৰ্য্য হৃদয়ঙ্গম করিবে ৷ আশা করি ভগবান আমাকে তাহার অপার করুণার যে আলােক দেখাইয়াছেন, তােমাকেও দেখাইবেন, কিন্তু সে তাহারই ইচ্ছার উপর নির্ভর করে ৷ তুমি যদি আমার সহধর্মিণী হইতে চাও, তাহা হইলে প্রাণপণে চেষ্টা করিবে যাহাতে তিনি তােমার একান্ত ইচ্ছার বলে তােমাকেও করুণা করিয়া পথ দেখাইবেন ৷ এই পত্র কাহাকেও দেখিতে দিবে না, কারণ যে কথা বলিয়াছি, সে অতিশয় গােপনীয় ৷ তােমা ছাড়া আর কাহাকেও বলি নাই, বলা নিষিদ্ধ ৷ আজ এই পর্যন্ত ৷
পুনশ্চ - সংসারের কথা সরােজিনীকে লিখিয়াছি, আলাদা তােমাকে লেখা অনাবশ্যক, তাহার পত্র দেখিয়া বুঝিবে ৷
6th December, 1907
আমি পরশ্ব চিঠি পাইয়াছিলাম, সে দিনই র্যাপারও পাঠান হইয়াছিল, কেন পাও নাই তাহা বুঝিতে পারিলাম না ৷
আমার এইখানে এক মুহূর্তও সময় নাই; লেখার ভার আমার উপর, কংগ্রেস সংক্রান্ত কাজের ভার আমার উপর, বন্দে মাতরমের গােলমাল মিটাইবার ভার আমার উপর ৷ আমি পেরে উঠছি না ৷ তাহা ছাড়া আমার নিজের কাজও আছে, তাহাও ফেলিতে পারি না ৷
আমার একটী কথা শুনিবে কি? আমার এখন বড় দুর্ভাবনার সময়, চারিদিকে যে টান পড়েছে পাগল হইবার কথা ৷ এই সময় তুমি অস্থির হইলে আমারও চিন্তা ও দুর্ভাবনা বৃদ্ধি হয়, তুমি উৎসাহ ও সান্ত্বনাময় চিঠি লিখিলে আমার বিশেষ শক্তিলাভ হইবে, প্রফুল্লচিত্তে সব বিপদ ও ভয় অতিক্রম করিতে পারিব ৷ জানি দেওঘরে একেলা থাকিতে তােমার কষ্ট হয়, তবে মনকে দৃঢ় করিলে এবং বিশ্বাসের উপর নির্ভর করিলে দুঃখ তত মনের উপর আধিপত্য করিতে পারিবে না ৷ যখন তােমার সহিত আমার বিবাহ হইয়াছে, তােমার ভাগ্যে এই দুঃখ অনিবাৰ্য্য, মাঝে মাঝে বিচ্ছেদ হইবেই, কারণ আমি সাধারণ বাঙ্গালীর মত পরিবার বা স্বজনের সুখ জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য করিতে পারি না ৷ এই অবস্থায় আমার ধৰ্ম্মই তােমার ধৰ্ম্ম, আমার নির্দিষ্ট কাজের সফলতায় তােমার সুখ না ৷ ভাবিলে তােমার অন্য উপায় নাই ৷ আর একটা কথা, যাহাদের সঙ্গে তুমি এখন থাক, তাহারা অনেকে তােমার আমার গুরুজন, তাহারা কটুবাক্য বলিলে, অন্যায় কথা বলিলে, তথাপি তাহাদের উপর রাগ করাে না ৷ আর যাহা বলেন তাহা ৷ যে সবই তাঁহাদের মনের কথা বা তােমাকে দুঃখ দিবার জন্যে বলা হইয়াছে তাহা বিশ্বাস করাে না ৷ অনেকবার রাগের মাথায় না ভেবে কথা বেরােয়, তাহা ধরে থাকা ভাল নয় ৷ যদি নিতান্ত না থাকিতে পার আমি গিরিশ বাবুকে বলিব, তােমার দাদামহাশয় বাড়ীতে থাকিতে পারেন আমি যতদিন কংগ্রেসে থাকি ৷
আমি আজ মেদিনীপুরে যাব ৷ ফিরে এসে এখানকার সব ব্যবস্থা করে সুরাটে যাব ৷ হয়ত 15th or 16thই যাওয়া হইবে ৷ জানুয়ারি ২রা তারিখে ফিরিয়া আসিব ৷
তাে—
23 Scott's Lane, Calcutta 21-2-08
কলেজের মাইনে পেতে দেরি হবে বলে রাধাকুমুদ মুখার্জীর কাছে পঞ্চাশ টাকা ধার করিয়া পাঠাইলাম ৷ অবিনাশকে পাঠাইতে বলিয়াছি, সে টেলিগ্রাফ করিয়া পাঠাইয়া থাকিবে, কিন্তু তােমার নামে পাঠাইতে ভুলিয়া গেলাম ৷ তাহা হইতে ভাড়ার টাকা বাদ দিয়া যা বাকি থাকে কতকটা মার জন্যে রাখিয়া কতকটা ধার চুকাইয়া দিবে ৷ আগামী মাসে ফেব্রুয়ারি ও জানুয়ারি মাসের মাহিনা তিনশ টাকা পাইব, তখন বাকি ধার চুকাইতে পারিব ৷
আগে যে চিঠি লিখেছিলাম, তার কথা এখন থাক ৷ তুমি এলে সব কথা বলিব, হুকুম পাইয়াছি, আর না বলিয়া থাকিতে পারিব না ৷ আজ এই পর্যন্ত ৷
অনেক দিন তােমাকে চিঠি লিখি নাই ৷ আমার বােধ হয় শীঘ্র আমাদের জীবনে একটী বৃহৎ পরিবর্তন হইবে ৷ যদি হয়, তাহা হইলে আমাদের সকল অভাব দূর হইবে ৷ মায়ের ইচ্ছার অপেক্ষায় রহিলাম ৷ আমার ভিতরেও শেষ পরিবর্তন হইতেছে ৷ মায়ের আবেশ ঘন ঘন হইতেছে ৷ একবার এই পরিবর্তন শেষ হইলে, আবেশ স্থায়ী হইলে, আর আমাদের বিচ্ছেদ থাকিতে পারে না ৷ কারণ যােগসিদ্ধির দিন নিকটবর্তী ৷ তাহার পর সম্পূর্ণ কার্য্যের স্রোত ৷ কাল পরশুর মধ্যে কোন লক্ষণ প্রকাশ হইবে ৷ তাহার পর তােমার সঙ্গে দেখা করিব ৷
মৃণালিনী,
অনেকদিন হল তােমার চিঠি পেয়েছি, উত্তর দিতে পারি নি ৷ তার কয়েকদিন পরে আমার জড়বৎ অবস্থা হয়ে সর্বপ্রকার কর্ম ও লেখা বন্ধ করা হয়েছে ৷ আজ আবার প্রবৃত্তি জেগেছে, তােমায় চিঠির উত্তর দিতে পারিলাম ৷
Home
Sri Aurobindo
Books
Bengali
Share your feedback. Help us improve. Or ask a question.