CWSA Set of 37 volumes
Writings in Bengali and Sanskrit Vol. 9 of CWSA 715 pages 2017 Edition
Bengali
 PDF   

Editions

ABOUT

All writings in Bengali and Sanskrit including brief works written for the newspaper 'Dharma' and 'Karakahini' - reminiscences of detention in Alipore Jail.

Writings in Bengali and Sanskrit

Sri Aurobindo symbol
Sri Aurobindo

All writings in Bengali and Sanskrit. Most of the pieces in Bengali were written by Sri Aurobindo in 1909 and 1910 for 'Dharma', a Calcutta weekly he edited at that time; the material consists chiefly of brief political, social and cultural works. His reminiscences of detention in Alipore Jail for one year ('Tales of Prison Life') are also included. There is also some correspondence with Bengali disciples living in his ashram. The Sanskrit works deal largely with philosophical and cultural themes. (This volume will be available both in the original languages and in a separate volume of English translations.)

The Complete Works of Sri Aurobindo (CWSA) Writings in Bengali and Sanskrit Vol. 9 715 pages 2017 Edition
Bengali
 PDF   

বাংলা রচনা




জাতীয়তা




অতীতের সমস্যা

শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রায় শতবর্ষ কাল পাশ্চাত্য ভাবের সম্পূর্ণ আধিপত্যে ভারতবাসী আৰ্যজ্ঞানে ও আৰ্য্যভাবে বঞ্চিত হইয়া শক্তিহীন, পরাশ্রয়প্রবণ ও অনুকরণপ্রিয় হইয়া রহিয়াছিল ৷ এই তামসিক ভাব এখন অপনােদিত হইতেছে ৷ কেন ইহার উদ্ভব হইয়াছিল, তাহা একবার মীমাংসা করা আবশ্যক ৷ অষ্টাদশ শতাব্দীতে তামসিক অজ্ঞান ও ঘাের রাজসিক প্রবৃত্তি ভারতবাসীকে গ্রাস করিয়াছিল, দেশে সহস্র স্বার্থপর, কর্তব্যপরাঘুখ, দেশদ্রোহী, শক্তিমান অসুরপ্রকৃতি লােক জন্মগ্রহণ করিয়া পরাধীনতার অনুকূল অবস্থা প্রস্তুত করিয়াছিল ৷ সেই সময়ে ভগবানের গূঢ় অভিসন্ধি সম্পাদনার্থ ভারতে দূর দ্বীপান্তরবাসী ইংরাজ বণিকের আবির্ভাব হইয়াছিল ৷ পাপভারাৰ্ত্ত ভারতবর্ষ অনায়াসে বিদেশীর করতলগত হইল ৷ এই অদ্ভুত কাণ্ড ভাবিয়া এখনও জগৎ আশ্চর্যান্বিত ৷ ইহার কোনও সন্তোষজনক ৷ মীমাংসা করিতে না পারিয়া সকলেই ইংরাজ জাতির গুণের অশেষ প্রশংসা করিতেছে ৷ ইংরাজ জাতির অনেক গুণ আছে; না থাকিলে তাহারা পৃথিবীর শ্ৰেষ্ঠ দিগ্বিজয়ী জাতি হইতে পারিতেন না ৷ কিন্তু যাঁহারা বলেন ভারতবাসীর নিকৃষ্টতা, ইংরাজের শ্রেষ্ঠতা, ভারতবাসীর পাপ, ইংরাজের পুণ্য এই অদ্ভুত ঘটনার একমাত্র কারণ তাঁহারা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত না হইয়াও লােকের মনে কয়েকটী ভ্রান্ত ধারণা উৎপাদন করিয়াছেন ৷ অতএব এই বিষয়ের সূক্ষ্ম অনুসন্ধানপূর্বক নির্ভুল মীমাংসা করিবার চেষ্টা করা যাউক ৷ অতীতের সূক্ষ্ম সন্ধানের অভাবে ভবিষ্যতের গতি নির্ণয় করা দুঃসাধ্য ৷

ইংরাজের ভারত-বিজয় জগতের ইতিহাসে অতুলনীয় ঘটনা ৷ এই বৃহৎ দেশ যদি অসভ্য, দুৰ্বল বা নির্বোধ ও অক্ষম জাতির বাসস্থান হইত, তাহা হইলে এইরূপ কথা বলা যাইত না ৷ কিন্তু ভারতবর্ষ রাজপুত, মারাঠা, শিখ, পাঠান, মােগল প্রভৃতির বাসভূমি; তীক্ষ্মবুদ্ধি বাঙ্গালী, চিন্তাশীল মাদ্রাজী, রাজনীতিজ্ঞ মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ ভারতজননীর সন্তান ৷ ইংরাজের বিজয়ের সময়ে নানা ফড়নবীসের ন্যায় বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ, মাধােজী সিন্ধিয়ার ন্যায় যুদ্ধ-বিশারদ সেনাপতি, হায়দর আলি ও রঞ্জিত সিংহের ন্যায় তেজস্বী ও প্রতিভাশালী রাজ্য-নির্মাতা প্রদেশে প্রদেশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন ৷ অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভারতবাসী তেজে, শৌর্য্যে, বুদ্ধিতে কোনও জাতির অপেক্ষা নন ছিলেন না ৷ অষ্টাদশ শতাব্দীর ভারত সরস্বতীর মন্দির, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, শক্তির ক্রীড়াস্থান ছিল ৷ অথচ যে-দেশ প্রবল ও বর্ধনশীল মুসলমান শত শত বর্ষব্যাপী প্রয়াসে অতিকষ্টে জয় করিয়া কখনও নির্বিঘ্নে শাসন করিতে পারেন নাই, সেই দেশ পঞ্চাশ বৎসরের মধ্যে অনায়াসেমুষ্টিমেয়ইংরাজ বণিকের আধিপত্য স্বীকার করিল, শতবৎসরের মধ্যে তাহাদের একচ্ছত্র সাম্রাজ্যের ছায়ায় নিশ্চেষ্টভাবে নিদ্রিত হইয়া পড়িল! বলিবে একতার অভাব এই পরিণামের কারণ ৷ স্বীকার করিলাম, একতার অভাব আমাদের দুর্গতির একটি প্রধান কারণ বটে, কিন্তু ভারতবর্ষে কোনও কালেও একতা ছিল না ৷মহাভারতের সময়েও একতা ছিল না, চন্দ্রগুপ্ত ও অশােকের সময়েও ছিল না, মুসলমানের ভারতবিজয়কালেও ছিল না, অষ্টাদশ শতাব্দীতেও ছিল না ৷ একতার অভাব এই অদ্ভুত ঘটনার একমাত্র কারণ হইতে পারে না ৷ যদি বল, ইংরাজদিগের পুণ্য ইহার কারণ, জিজ্ঞাসা করি যাঁহারা সেই সময়ের ইতিহাস অবগত আছেন, তাহারা কি বলিতে সাহসী হইবেন যে, সেইকালের ইংরাজ বণিক সেইকালের ভারতবাসীর অপেক্ষা গুণে ও পুণ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন? যে ক্লাইভ ও ওয়ারেন হেষ্টিংস্ প্রমুখ ইংরাজ বণিক ও দস্যুগণ ভারতভূমি জয় ও লুণ্ঠন করিয়া জগতে অতুলনীয় সাহস, উদ্যম ও আত্মম্ভরিতা এবং জগতে অতুলনীয় দুগুণেরও দৃষ্টান্ত দেখাইয়া গিয়াছেন, সেই নিষ্ঠুর, স্বার্থপর, অর্থলােলুপ, শক্তিমান অসুরগণের পুণ্যের কথা শ্রবণ করিলে হাস্য সম্বরণ করা দুষ্কর ৷ সাহস, উদ্যম ও আত্মম্ভরিতা অসুরের গুণ, অসুরের পুণ্য, সেই পুণ্য ক্লাইভ প্রভৃতি ইংরাজগণের ছিল ৷ কিন্তু তাহাদের পাপ ভারতবাসীর পাপ অপেক্ষা কিছুমাত্র ন্যূন ছিল না ৷ অতএব ইংরাজের পুণ্যে এই অঘটন ঘটন হয় নাই ৷

ইংরাজও অসুর ছিলেন, ভারতবাসীও অসুর ছিলেন, তখন দেবে অসুরে যুদ্ধ হয় নাই, অসুরে অসুরে যুদ্ধ হইয়াছে ৷ পাশ্চাত্য অসুরে এমন কি মহৎ গুণ ছিল যাহার প্রভাবে তাহাদের তেজ, শৌর্য্য ও বুদ্ধি সফল হইল, ভারতবাসী অসুরে এমন কি সাংঘাতিক দোষ ছিল যাহার প্রভাবে তাহাদের তেজ, শৌর্য্য ও বুদ্ধি বিফল হইল? প্রথম উত্তর এই, ভারতবাসী আর সকল গুণে ইংরাজের সমান হইয়াও জাতীয়ভাবরহিত ছিলেন, ইংরাজের মধ্যে সেই গুণের পূর্ণ বিকাশ ছিল ৷ এই কথায় যেন কেহ না বুঝেন যে, ইংরাজগণ স্বদেশপ্রেমিক ছিলেন; স্বদেশপ্রেমের প্রেরণায় ভারতে বিপুল সাম্রাজ্য গঠন করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন ৷ স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়ভাব স্বতন্ত্র বৃত্তি ৷ স্বদেশপ্রেমিক স্বদেশের সেবাভাবে উন্মত্ত, সর্বত্র স্বদেশকে দেখেন, সকল কাৰ্য্য স্বদেশকে ইষ্টদেবতা বলিয়া যজ্ঞরূপে সমর্পণ করিয়া দেশের হিতের জন্যই করেন, দেশের স্বার্থে আপনার স্বার্থ ডুবাইয়া দেন ৷ অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংরাজগণের সেই ভাব ছিল না; সেই ভাব কোন জড়বাদী পাশ্চাত্য জাতির প্রাণে স্থায়ীরূপে থাকিতে পারে না ৷ ইংরাজগণ স্বদেশের হিতার্থে ভারতে আসেন নাই, স্বদেশের হিতার্থে ভারতবিজয় করেন নাই, তাহারা বাণিজ্যার্থ, নিজ নিজ আর্থিক লাভার্থ আসিয়াছিলেন; স্বদেশের হিতার্থে ভারতবিজয় ও লুণ্ঠন করেন নাই, অনেকটা নিজ স্বার্থ সিদ্ধ্যর্থে জয় ও লুণ্ঠন করিয়াছিলেন ৷ কিন্তু স্বদেশপ্রেমিক না হইয়াও তঁাহারা জাতীয়ভাবাপন্ন ছিলেন ৷ আমার দেশ শ্রেষ্ঠ, আমার জাতির আচার, বিচার, ধৰ্ম্ম, চরিত্র, নীতি, বল, বিক্রম, বুদ্ধি, মত, কৰ্ম্ম উৎকৃষ্ট, অতুল্য এবং অন্য জাতির পক্ষে দুর্লভ – এই অভিমান; আমার দেশের হিতে আমার হিত, আমার দেশের গৌরবে আমার গৌরব, আমার দেশ-ভাইয়ের বৃদ্ধিতে আমি বৰ্দ্ধিত —এই বিশ্বাস; কেবল আমার স্বার্থসাধন না করিয়া তাহার সহিত দেশের স্বার্থ সম্পাদন করিব, দেশের মান, গৌরব ও বৃদ্ধির জন্য যুদ্ধ করা প্রত্যেক দেশবাসীর কর্তব্য, আবশ্যক হইলে সেই যুদ্ধে নির্ভয়ে প্রাণবিসর্জন করা বীরের ধর্ম, এই কৰ্ত্তব্যবুদ্ধি জাতীয় ভাবের প্রধান লক্ষণ ৷ জাতীয় ভাব রাজসিক ভাব, স্বদেশপ্রেম সাত্ত্বিক ৷ যিনি নিজের “অহং” দেশের “অহং”-এ বিলীন করিতে পারেন, তিনি আদর্শ স্বদেশপ্রেমিক, যিনি নিজের “অহং” সম্পূর্ণ বজায় রাখিয়া তাহার দ্বারা দেশের “অহং” বর্ধিত করেন তিনি জাতীয়ভাবাপন্ন ৷ সেই কালের ভারতবাসীরা জাতীয়ভাবশূন্য ছিলেন ৷ তাঁহারা যে কখনও জাতির হিত দেখিতেন না, এমন কথা বলি না, কিন্তু জাতির ও আপনার হিতের মধ্যে লেশমাত্র বিরােধ থাকিলে প্রায়ই জাতির হিত বিসৰ্জন করিয়া নিজ হিত সম্পাদন করিনে ৷ একতার অভাব অপেক্ষা এই জাতীয়তার অভাব আমাদের মতে মারাত্মক দোষ ৷ পূর্ণ জাতীয় ভাব দেশময় ব্যাপ্ত হইলে এই নানা ভেদসঙ্কল দেশেও একতা সম্ভব; কেবল একতা চাই, একতা চাই বলিলে একতা সাধিত হয় না; ইহাই ইংরাজের ভারতবিজয়ের প্রধান কারণ ৷ অসুরে অসুরে সংঘর্ষ হইল, জাতীয়ভাবাপন্ন একতাপ্রাপ্ত অসুরগণ জাতীয়ভাবশূন্য একতাশূন্য সমানগুণবিশিষ্ট অসুরগণকে পরাজিত করিলেন ৷ বিধাতার এই নিয়ম, যিনি দক্ষ ও শক্তিমান তিনিই কুস্তিতে জয়ী হয়েন; যিনি ক্ষিপ্রগতি ও সহিষ্ণু তিনিই দৌড়ে প্রথম গন্তব্যস্থানে পৌঁছেন ৷ সচ্চরিত্র বা পুণ্যবান বলিয়া কেহ দৌড়ে বা কুস্তিতে জয়ী হন নাই, উপযুক্ত শক্তি আবশ্যক ৷ তেমনই জাতীয়ভাবের বিকাশে দুবৃত্ত ও আসুরিক জাতিও সাম্রাজ্য-স্থাপনে সক্ষম হয়, জাতীয়ভাবের অভাবে সচ্চরিত্র ও গুণসম্পন্ন জাতিও পরাধীন হইয়া শেষে চরিত্র ও গুণ হারাইয়া অধােগতি প্রাপ্ত হয় ৷

রাজনীতির দিক দেখিলে ইহাই ভারত-বিজয়ের শ্রেষ্ঠ মীমাংসা; কিন্তু ইহার মধ্যে আরও গভীর সত্য নিহিত আছে ৷ বলিয়াছি, তামসিক অজ্ঞান ও রাজসিক প্রবৃত্তি ভারতে অতি প্রবল হইয়াছিল ৷ এই অবস্থা পতনের অগ্রগামী অবস্থা ৷ রজোগুণসেবায় রাজসিক শক্তির বিকাশ হয়; কিন্তু অমিশ্র রজঃ শীঘ্র তমােমুখী হয়, উদ্ধত শৃঙ্খলাবিহীন রাজসিক চেষ্টা অতি শীঘ্র অবসন্ন ও শ্রান্ত হইয়া অপ্রবৃত্তি, শক্তিহীনতা, বিষাদ ও নিশ্চেষ্টতায় পরিণত হয় ৷ সত্ত্বমুখী হইলেই রজঃশক্তি স্থায়ী হয় ৷ সাত্ত্বিক ভাব যদিও না থাকে, সাত্ত্বিক আদর্শ আবশ্যক; সেই আদর্শ দ্বারা রজঃশক্তি শৃঙ্খলিত ও স্থায়ী-বলপ্রাপ্ত হয় ৷ স্বাধীনতা ও সুশৃঙ্খলতা ইংরাজের এই দুই মহান সাত্ত্বিক আদর্শ চিরকাল ছিল, তাহার বলে ইংরাজ জগতে প্রধান ও চিরজয়ী ৷ ঊনবিংশ শতাব্দীতে পরােপকারলিন্সও জাতির মধ্যে জাগ্রত হইয়াছিল, তাহার বলে ইংলণ্ড জাতীয় মহত্ত্বের চরমাবস্থায় উপনীত হইয়াছিল ৷ উপরন্তু য়ুরােপে যে জ্ঞানতৃষ্ণার প্রবল প্রেরণায় পাশ্চাত্য জাতি শত শত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করিয়াছেন, কণামাত্র জ্ঞানলাভের জন্য শত শত লােক প্রাণ পৰ্য্যন্ত দিতে সম্মত হন, সেই বলীয়সী সাত্ত্বিক জ্ঞানতৃষ্ণা ইংরাজ জাতির মধ্যে বিকশিত ছিল ৷ এই সাত্ত্বিক শক্তিতে ইংরাজ বলবান ছিলেন, এই সাত্ত্বিক শক্তি ক্ষীণ হইতেছে বলিয়া ইংরাজের প্রাধান্য, তেজ ও বিক্রম ক্ষীণ হইয়া ভয়, বিষাদ ও আত্মশক্তির উপর অবিশ্বাস বৃদ্ধি পাইতেছে ৷ সাত্ত্বিক লক্ষ্যভ্রষ্ট রজঃশক্তি তমােমুখী হইতেছে ৷ অপরপক্ষে ভারতবাসীগণ মহান সাত্ত্বিক জাতি ছিলেন ৷ সেই সাত্ত্বিক বলে জ্ঞানে, শৌর্য্যে, তেজে, বলে তাঁহারা অতুলনীয় হইয়াছিলেন এবং একতাবিহীন হইয়াও সহস্র বর্ষকাল ধরিয়া বিদেশীর আক্রমণের প্রতিরােধ ও দমনে সমর্থ ছিলেন ৷ শেষে রজোবৃদ্ধি ও সত্ত্বের হাস হইতে লাগিল ৷ মুসলমানের আগমনকালে জ্ঞানের বিস্তার সঙ্কুচিত হইতে আরম্ভ হইয়াছিল, তখন রজঃপ্রধান রাজপুতজাতি ভারতের সিংহাসনে অধিরূঢ়; উত্তর ভারতে যুদ্ধবিগ্রহ আত্মকলহের প্রাধান্য; বঙ্গদেশে বৌদ্ধধর্মের অবনতিতে তামসিকভাব প্রবল ৷ অধ্যাত্মজ্ঞান দক্ষিণ ভারতে আশ্রয় লইয়াছিল; সেই সত্ত্ববলে দক্ষিণ ভারত অনেকদিন স্বাধীনতা রক্ষা করিতে সক্ষম হইয়াছিল ৷ জ্ঞানতৃষ্ণা এবং জ্ঞানের উন্নতি বন্ধ হইতে চলিল, তাহার স্থানে পাণ্ডিত্যের মান ও গৌরব বর্ধিত হইল; আধ্যাত্মিক জ্ঞান, যােগশক্তি বিকাশ ও আভ্যন্তরিক উপলব্ধির স্থানে তামসিক পূজা ও সকাম রাজসিক ব্রতােদ্যাপনের বাহুল্য হইতে লাগিল, বর্ণাশ্রমধৰ্ম্ম লুপ্ত হইলে লােকে বাহ্যিক আচার ও ক্রিয়া অধিক মূল্যবান ভাবিতে আরম্ভ করিল ৷ এইরূপ জাতিধৰ্ম্ম লােপেই গ্রীস, রােম, মিসর, আসিরিয়ার মৃত্যু হইয়াছিল; কিন্তু সনাতন ধর্মাবলম্বী আৰ্যজাতির মধ্যে সেই সনাতন উৎস হইতে মধ্যে মধ্যে সঞ্জীবনী সুধাধারা নির্গত হইয়া জাতির প্রাণরক্ষা করিত ৷ শঙ্কর, রামানুজ, চৈতন্য, নানক, রামদাস, তুকারাম সেই অমৃতসিঞ্চন করিয়া মরণাহত ভারতে প্রাণসঞ্চার করিয়াছেন ৷ অথচ রজঃ ও তমঃ স্রোতের এমন বল ছিল যে সেই টানে উত্তমও অধমে পরিণত হইল; সাধারণ লােকে শঙ্করদত্ত জ্ঞান দ্বারা তামসিক ভাবের সমর্থন করিতে লাগিল, চৈতন্যের প্রেমধর্ম ঘাের তামসিক নিশ্চেষ্টতার আশ্রয়ে পরিণত হইল, রামদাসের শিক্ষাপ্রাপ্ত মহারাষ্ট্রীয়গণ মহারাষ্ট্রধর্ম বিস্মৃত হইয়া স্বার্থসাধনে ও আত্মকলহে শক্তির অপব্যবহার করিয়া শিবাজী ও বাজীরাওয়ের প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্য বিনষ্ট করিলেন ৷ অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই স্রোতের পূর্ণ বেগ দেখা গেল ৷ সমাজ ও ধর্ম তখন কয়েকজন আধুনিক বিধানকর্তার ক্ষুদ্র গণ্ডীতে আবদ্ধ, বাহ্যিক আচার ও ক্রিয়ার আড়ম্বর ধর্ম নামে অভিহিত, আৰ্যজ্ঞান লুপ্তপ্রায়, আৰ্য্যচরিত্র বিনষ্টপ্রায়, সনাতন ধর্ম সমাজকে পরিত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসীর অরণ্যবাসে ও ভক্তের হৃদয়ে লুকাইয়া রহিল ৷ ভারত তখন ঘাের তমঃ-অন্ধকারে আচ্ছন্ন, অথচ প্রচণ্ড রাজসিক প্রবৃত্তি বাহ্যিক ধর্মের আবরণে স্বার্থ, পাপ, দেশের অকল্যাণ, পরের অনিষ্ট পূর্ণবেগে সাধন করিতেছিল ৷ দেশে শক্তির অভাব ছিল না, কিন্তু আৰ্য্যধৰ্ম্মলােপে, সত্ত্বলােপে সেই শক্তি আত্মরক্ষায় অসমর্থ হইয়া আত্মবিনাশ করিল ৷ শেষে ইংরাজের আসুরিক শক্তির নিকট পরাজিত হইয়া ভারতের আসুরিক শক্তি শৃঙ্খলিত ও মুমূর্ষ হইয়া পড়িল ৷ ভারত পূর্ণ তমােভাবের ক্রোড়ে নিদ্রিত হইয়া পড়িল ৷ অপ্রকাশ, অপ্রবৃত্তি, অজ্ঞান, অকর্মণ্যতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব, আত্মসম্মান বিসর্জন, দাসত্বপ্রিয়তা, পরধর্মসেবা, পরের অনুকরণ, পরাশ্রয়ে আত্মােন্নতি চেষ্টা, বিষাদ, আত্মনিন্দা, ক্ষুদ্রাশয়তা, আলস্য ইত্যাদি সকলই তমােভাবপ্রকাশক গুণ ৷ এই সকলের মধ্যে ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতে কোনটির অভাব ছিল? সেই শতাব্দীর সর্ব চেষ্টা এই গুণসকলের প্রাবল্যে তমঃশক্তির চিহ্নে সর্বত্র চিহ্নিত ৷

ভগবান যখন ভারতকে জাগাইলেন, তখন সেই জাগরণের প্রথম আবেগে জাতীয়ভাবের উদ্দীপনার জ্বালাময়ী শক্তি জাতির শিরায় শিরায় খরতরবেগে বহিতে লাগিল ৷ তাহার সহিত স্বদেশপ্রেমের উন্মদকর আবেগ যুবকবৃন্দকে অভিভূত করিল ৷ আমরা পাশ্চাত্যজাতি নহি, আমরা আসিয়াবাসী, আমরা ভারতবাসী, আমরা আর্য্য ৷ আমরা জাতীয়ভাব প্রাপ্ত হইয়াছি, কিন্তু তাহার মধ্যে স্বদেশপ্রেমের সঞ্চার না হইলে আমাদের জাতীয়ভাব পরিস্ফুট হয় না ৷ সেই স্বদেশপ্রেমের ভিত্তি মাতৃপূজা ৷ যেদিন বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম্ গান বাহ্যেন্দ্রিয় অতিক্রম করিয়া প্রাণে আঘাত করিল, সেইদিন আমাদের হৃদয়ের মধ্যে স্বদেশপ্রেম জাগিল, মাতৃমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হইল ৷ স্বদেশ মাতা, স্বদেশ ভগবান, এই বেদান্ত-শিক্ষার অন্তর্গত মহতী শিক্ষা জাতীয় অভ্যুত্থানের বীজস্বরূপ ৷ যেমন জীব ভগবানের অংশ, তাহার শক্তি ভগবানের শক্তির অংশ, তেমনই এই সপ্তকোটী বঙ্গবাসী, এই ত্রিংশকোটী ভারতবাসীর সমষ্টি সৰ্বব্যাপী বাসুদেবের অংশ; এই ত্রিংশকোটীর আশ্রয়, শক্তিস্বরূপিণী, বহুভুজান্বিতা, বহুবলধারিণী ভারত-জননী ভগবানের একটী শক্তি, মাতা, দেবী, জগজ্জননী কালীর দেহবিশেষ ৷ এই মাতৃপ্রেম, মাতৃমূৰ্ত্তি জাতির মনে প্রাণে জাগরিত ও প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য এই কয় বর্ষের উত্তেজনা, উদ্যম, কোলাহল, অপমান, লাঞ্ছনা, নিৰ্যাত্ম ভগবানের বিধানে বিহিত ছিল ৷ সেই কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়াছে ৷ তাহার পরে কি?

তাহার পরে আর্যজাতির সনাতন শক্তির পুনরুদ্ধার ৷ প্রথম আৰ্য্যচরিত্র ও শিক্ষা, দ্বিতীয় যােগশক্তির পুনর্বিকাশ, তৃতীয় আৰ্য্যোচিত জ্ঞানতৃষ্ণা ও কর্মশক্তির দ্বারা নবযুগের আবশ্যক সামগ্রী সঞ্চয় এবং এই কয় বর্ষের উন্মাদিনী উত্তেজনা শৃঙ্খলিত ও স্থিরলক্ষ্যের অভিমুখী করিয়া মাতৃকার্যোদ্ধার ৷ এখন যে-সব যুবকবৃন্দ দেশময় পথান্বেষণ ও কৰ্ম্মান্বেষণ করিতেছেন, তাহারা উত্তেজনা অতিক্রম করিয়া কিছুদিন শক্তি আনয়নের পথ খুঁজিয়া লউন ৷ যে মহৎ কাৰ্য্য সমাধা করিতে হইবে, তাহা কেবল উত্তেজনার দ্বারা সম্পন্ন হইতে পারে না, শক্তি চাই ৷ তােমাদিগের পূৰ্বপুরুষদের শিক্ষায় যে শক্তি প্রাপ্ত হওয়া যায় সেই শক্তি অঘটনঘটনপটীয়সী ৷ সেই শক্তি তােমাদের শরীরে অবতরণ করিতে উদ্যত হইতেছেন ৷ সেই শক্তিই মা ৷ তাহাকে আত্মসমর্পণ করিবার উপায় শিখিয়া লও ৷ মা তােমাদিগকে যন্ত্র করিয়া এত সত্বর, এমন সবলে কাৰ্য্য সম্পাদন করিবেন যে, জগৎ স্তম্ভিত হইবে ৷ সেই শক্তির অভাবে তােমাদের সকল চেষ্টা বিফল হইবে ৷ মাতৃমূৰ্ত্তি তােমাদের ৷ হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত, তােমরা মাতৃপূজা ও মাতৃসেবা করিতে শিখিয়াছ, এখন অন্তর্নিহিত মাতাকে আত্মসমর্পণ কর ৷ কার্যোদ্ধারের অন্য পন্থা নাই ৷









Let us co-create the website.

Share your feedback. Help us improve. Or ask a question.

Image Description
Connect for updates