All writings in Bengali and Sanskrit including brief works written for the newspaper 'Dharma' and 'Karakahini' - reminiscences of detention in Alipore Jail.
All writings in Bengali and Sanskrit. Most of the pieces in Bengali were written by Sri Aurobindo in 1909 and 1910 for 'Dharma', a Calcutta weekly he edited at that time; the material consists chiefly of brief political, social and cultural works. His reminiscences of detention in Alipore Jail for one year ('Tales of Prison Life') are also included. There is also some correspondence with Bengali disciples living in his ashram. The Sanskrit works deal largely with philosophical and cultural themes. (This volume will be available both in the original languages and in a separate volume of English translations.)
অসম্ভবের অনুসন্ধান
হুগলীতে প্রাদেশিক সমিতির যে অধিবেশন হইয়া গিয়াছে তাহাতে সভাপতি শ্ৰীযুত বৈকুণ্ঠনাথ সেন জাতীয়দলকে অধীর ও অসম্ভব আদর্শের সন্ধানে ব্যস্ত বলিয়া অভিহিত করিতে কুণ্ঠিত হয়েন নাই ৷ যাঁহারা অধিবেশনের কার্যবিবরণ লক্ষ্য করিয়াছেন, তাঁহারা অবশ্যই স্বীকার করিবেন, মধ্যপন্থীরাই অধীরতার পরিচয় দিয়াছেন; জাতীয়দলের বিরুদ্ধে অধীরতার অভিযােগের কারণ নাই ৷ হুগলীতে যে জাতীয়দলের সংখ্যাধিক্য ছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই; অথচ বিরােধ-বর্জনের উদ্দেশ্যে জাতীয়দলের পক্ষ হইতে শ্ৰীযুত অরবিন্দ ঘােষ স্বাবলম্বন ও নিস্ক্রিয় প্রতিরােধ সমর্থন করিয়া ক্ষান্ত হইয়াছিলেন ৷ ইহাও যদি অধীরতা হয় তবে ধীরতা বােধ হয় জড়তার নামান্তর মাত্র ৷ অসম্ভব আদর্শের কথায় আমরা এই মাত্র বলিতে পারি যে, যাহারা বর্তমানের সঙ্কীর্ণ সীমার বাহিরে কিছুই দেখিতে চাহে না ও পারে না তাহারা ভবিষ্যতের ভাবনার ভাবুকদিগকে চিরদিনই অসম্ভব আদর্শের সন্ধানে ব্যস্ত বলিয়া উপহাস করিয়া থাকে ৷ যে সকল কৰ্ম্মবীর সঙ্কটসময়ে বিশেষ বিচার ও বিবেচনা করিয়া ভবিষ্যতের উন্নতির ভিত্তিস্থাপনক্ষম তাহাদের ভাগ্যেও ঐরূপ উপহাস লাভ ঘটিয়া থাকে ৷ ফলের বিষয় না জানিয়া অপেক্ষা করা জড়ত্ব, তাহা বুদ্ধির পরিচায়ক নহে ৷ সেখানে স্থৈর্য্য মূঢ়ের কাৰ্য্য; গতিই জীবন ৷ ভারতে মধ্যপন্থী সম্প্রদায়ের অকারণ ভীতিই জাতীয় উন্নতির অন্তরায় হইয়াছে ৷ সমগ্র প্রাচ্য ভূখণ্ডে যে জাগরণ, যে উন্নতির আকাঙ্ক্ষা, যে আবেগ আসিয়াছে জাপানে, পারস্যে, তুরস্কে তাহার প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে ৷ ভারতের বড়লাট লর্ড মিন্টোও স্বীকার করিয়াছেন, সে প্রবাহের গতিরােধ করা মানবের সাধ্যাতীত ৷ অথচ মধ্যপন্থীরা একথা বুঝেন না বা বুঝিয়াও বুঝেন না ৷ সর্বত্রই সংস্কারে প্রজাশক্তির আত্মবিকাশ দেখা যাইতেছে ৷ কেবল ভারতেই অপেক্ষার আদেশ প্রতিধ্বনিত হইতেছে! এই আদেশদাতা লর্ড মরলী – সমস্ত জীবন প্রজাশক্তির সমর্থন করিয়া জীবনের সায়াহ্নে ভারতবর্ষকে চিরকালের জন্যে জড়জীবনযাপনের আদেশ করিয়াছেন ৷ এ অবস্থায় – জাতীয়দলের উন্নতি চেষ্টা উপহাসাম্পদ না মধ্যপন্থীদিগের পরনির্ভরতা ও জড়ত্ব উপহাসাস্পদ?
যোগ্যতা বিচার
ভাবে বােধ হয়, সভাপতি মহাশয় অ্যাংলাে-ইণ্ডিয়ার কথায় অযথা বিশ্বাসবান হইয়া মনে করেন, আমরা আজও স্বায়ত্তশাসনের উপযুক্ত নহি ৷ স্বায়ত্তশাসন সম্বন্ধীয় প্রস্তাবের আলােচনাকালে একজন বক্তাও এই কথাই বলিয়াছিলেন! আমাদিগকে অনুপযুক্ত বলা ব্যতীত আংলাে-ইণ্ডিয়ার পক্ষে স্বেচ্ছাচার সমর্থনের অন্য উপায় নাই ৷ এ অবস্থায় অ্যাংলাে-ইণ্ডিয়ার স্বার্থ-সমর্থক যুক্তি স্বাভাবিক ও সঙ্গত ৷ কিন্তু ভারতবাসীর পক্ষে এই যুক্তি গ্রহণ করা অস্বাভাবিক ও অসঙ্গত ৷ গ্ল্যাডস্টোন বলিয়াছিলেন, স্বাধীনতাসম্ভোগই লােককে স্বাধীনতার উপযুক্ত করে ৷ স্বায়ত্তশাসন সম্ভোগ ব্যতীত স্বায়ত্তশাসনের উপযােগী হইবার উপায়ান্তর নাই আমরা অবগত আছি, স্বায়ত্তশাসন পাইলে প্রথম আমাদের ভ্ৰম-প্রমাদ অনিবাৰ্য্য ৷ সকল দেশেই এইরূপ হইয়াছে ৷ জাপানের ভ্রম হইয়াছে, তুরস্ক ও পারস্যে এখনও ভ্রম ঘটিতেছে ৷ তাই বলিয়া স্বায়ত্তশাসনের পথে অগ্রসর না হওয়া আর উন্নতির পথ চিরদিনের জন্য অর্গলবদ্ধ করা একই কথা ৷ ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমরা ভ্রান্ত শিক্ষায় আপনাদিগকে অসার ও অনুপযােগী বলিয়াই বিশ্বাস করিতে শিখিয়াছিলাম ৷ আজ সে ভ্রম অপগত ৷ আজ আমরা বুঝিয়াছি, এ জাতির জীবনস্পন্দন বন্ধ হয় নাই – এ জাতি জীবিত ৷ এই অনুভূতিই জাতীয় উন্নতির পক্ষে যথেষ্ট ৷ আর এই অনুভূতিই আমাদিগকে উন্নতির পথারূঢ় করিয়া রাজনীতিক্ষেত্রে মােক্ষলাভে সক্ষম করিবে ৷ এ অবস্থায় – আজ যখন উন্নতি আরব্ধ তখন – যােগ্যতা-বিচারের ছল করিয়া উন্নতির গতি বন্ধ করিয়া স্থির হওয়া মূঢ়ের কাৰ্য ৷ আজ জাতীয় জীবনে যে সময় উপস্থিত সে সময়ের গতি রুদ্ধ হইলে আমরা উন্নতির পথে পিছাইয়া পড়িব – অগ্রসর হইতে পারিব না ৷ সুতরাং আমাদিগকে অগ্রসরই হইতে হইবে; শঙ্কায় বা সন্দেহে বিচলিত না হইয়া স্থির ও ধীরপদে কর্ত্তব্যপথে অগ্রসর হওয়াই আজ আমাদের কর্ত্তব্য ৷
চাঞ্চল্য-চিহ্ন
আমাদের কোন কোন বিজ্ঞ মধ্যপন্থী এমন কথাও বলেন যে, আজকাল কোন কোন সভায় কিছু কিছু গােলমাল হয়; ইহাতে রাজনীতিক অধিকার লাভে আমাদের অযােগ্যতাই প্রতিপন্ন হইতেছে ৷ এ কথাটাও তাহাদের মৌলিক নহে, কপটাচারী অ্যাংলাে-ইণ্ডিয়ানদিগের মতের প্রতিধ্বনি মাত্র ৷ যে সকল অ্যাংলাে-ইণ্ডিয়ান এরূপ মত প্রকাশ করেন, আমরা তাঁহাদিগকে কপটাচারী বলিলাম, কারণ তাহারা অবশ্যই অবগত আছেন যে, বিলাতে রাজনীতিক সভাসমিতিতে যেরূপ গােলমাল হয় ভারতে সভাসমিতিতে তাহার শতাংশের একাংশও হয় না ৷ ধীর প্রকৃতির ভারতবাসীরা সেরূপ ব্যবহারে একান্ত অনভ্যস্ত ৷ আমাদের দেশে সভাসমিতিতে গােলযােগের দুইটী প্রধান দৃষ্টান্ত দেখা যায়; —সুরাটে সুরেন্দ্রনাথের কথায় কেহ কর্ণপাত করে নাই, তিনি বক্তৃতা বন্ধ করিয়া বসিতে বাধ্য হইয়াছিলেন, আর সুরাটেই মধ্যপন্থীরা শ্ৰীযুত বাল গঙ্গাধর তিলককে প্রহার করিতে উদ্যত হইলে বিষম গােলযােগ উৎপন্ন হয় ৷ ইংলণ্ডে এরূপ ঘটনা সচরাচর ঘটিয়া ৷ থাকে ৷ কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের সভায় প্রধানমন্ত্রী মিষ্টার ব্যালফোর গােলমালে বক্তৃতা করিতে পারেন নাই, শেষে দুইজন ছাত্র নারী বেশে মঞ্চে উঠিয়া তাহাকে জুতার মালা উপহার দেয় ৷ তিনি হাসিতে হাসিতে সে উপহার গ্রহণ করিয়াছিলেন ৷ আর একবার ছাত্রগণ কোন বক্তার বক্তৃতায় অসন্তুষ্ট হইয়া মারামারি করে ও পুলিসকে বিষম প্রহার করে ৷ বিচারে ছাত্রদিগের কোনরূপ দণ্ড হয় নাই ৷ আমরা অবশ্য এমন কথা বলি না যে, আমাদের দেশে রাজনীতিক আন্দোলনে সভাসমিতিতে এইরূপ চাঞ্চল্য আরব্ধ হউক ৷ আমরা এই কথা বলিতে চাহি যে, এইরূপ চাঞ্চল্যে স্বায়ত্তশাসন লাভে আমাদের অযােগ্যতা প্রতিপন্ন হয় না; পরন্তু ইহা জীবনের লক্ষণ ৷ বরং ইহাতে প্রতিপন্ন হয় যে, আমরা যুগব্যাপী-জড়ত্ব-শাপ-মুক্ত হইয়া নবীন উদ্যমে নবীন শক্তিতে নূতন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করিতেছি ৷
হুগলীর পরিণাম
হুগলীতে প্রাদেশিক সমিতির অধিবেশন দ্বারা জাতীয় পক্ষের পথ অনেকটা পরিষ্কার হইয়া গিয়াছে ৷ মধ্যপন্থীদের মনের ভাব তাঁহাদের আচরণে বােঝা গেল, জাতীয় পক্ষের প্রাবল্যও সকলের অনুভূত হইল ৷ বঙ্গদেশ যে জাতীয় ভাবে পূর্ণ হইয়াছে, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই ৷ অনেকে সন্দেহ করিয়াছিলেন হুগলীতে জাতীয় পক্ষের দুর্বলতা ও সংখ্যার অপ্সতাই অনুভূত হইবে; কিন্তু তাহা না হইয়া বরং এই বর্ষকালব্যাপী দলন ও নিগ্রহে এই দলের কি অদ্ভুত শক্তিবৃদ্ধি এবং তরুণদলের হৃদয়ে কি গভীর জাতীয় ভাব ও দৃঢ় সাহস জন্মিয়াছে তাহা দেখিয়া প্রাণ আনন্দিত ও প্রফুল্ল হইল ৷ কেবলমাত্র কলিকাতা বা পূর্ববঙ্গ হইতে নহে, চব্বিশ পরগণা, হুগলী, হাওড়া, মেদিনীপুর ইত্যাদি পশ্চিমবঙ্গের জেলাসকল হইতে জাতীয় পক্ষের প্রতিনিধি সমিতিতে গিয়াছিলেন ৷ আর একটী শুভ লক্ষণ তেজস্বী ও ভাবপ্রবণ নবীন দলের পক্ষে যাহা সহজসাধ্য নহে অথচ বিশেষ প্রয়ােজনীয়, শৃঙ্খলা ও নেতাদের আজ্ঞানুবর্তিতাও হুগলীতে দেখা গেল ৷ জাতীয় পক্ষের নেতারা কখনও মধ্যপন্থী নেতাগণের ন্যায় স্বেচ্ছায় কার্য চালাইতে ইচ্ছুক হইবেন না, দলের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া গন্তব্যপথ নির্ণয় করিবেন, কিন্তু একবার পথ স্থির হইলে নেতার উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস আবশ্যক ৷ সেই বিশ্বাস যদি টলে, নূতন নেতা মনােনীত করা শ্রেয়স্কর, কিন্তু কাৰ্য্যের সময়ে প্রত্যেকে নিজের বুদ্ধি চালাইয়া একপ্রাণ হইয়া নেতাকে সাহায্য করা উচিত ৷ পথনির্ণয় স্বাধীন চিন্তা ও বহুজনের পরামর্শ নির্ণীত পথে সৈন্যের ন্যায় শৃঙ্খলা ও বাধ্যতা, ইহাই প্রজাতন্ত্রে কাৰ্য্যসিদ্ধির প্রকৃত উপায় ৷ অতএব হুগলী অধিবেশনে ইহাই প্রথম উপলব্ধি হয় যে, জাতীয় পক্ষ এক বৎসরের নিগ্রহ ও ভয় প্রদর্শনে অধিক বলান্বিত ও শৃঙ্খলাপ্রাপ্ত হইয়াছে ৷ ইহা এতদিনের অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ ৷
দ্বিতীয় ফল মধ্যপন্থীদের মনের ভাব কার্য্যে প্রকাশ হইয়াছে ৷ তাহারা শাসন-সংস্কার-প্রস্তাব গ্রহণ করিবেন, সে সংস্কার নির্দোষ হউক বা সদোষ হউক, দেশের হিতকর হউক বা অহিতকর হউক, তাহা সংস্কার নামে অভিহিত, অতএব গ্রহণীয়; তাহা লর্ড মরলীর প্রসূত মানস-সন্তান, অতএব গ্রহণীয়; পুরাকালের কংগ্রেসের চিরবাঞ্ছিত দুর্লভ স্বপ্ন, অতএব গ্রহণীয়; উপরন্তু মরলী-রিপন-প্রসূত স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের চরম অবস্থা আনয়নে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, অতএব গ্রহণীয় ৷ তাহাতে জাতীয় একতার আশা লুপ্তপ্রায় হউক বা না হউক, নেতাদের স্বপ্ন ভাঙিবার নহে ৷ বয়কটকে বিষরহিত প্রেমময় স্বদেশীতে পরিণত করাও নেতাদের স্থির অভিসন্ধি ৷ স্বয়ং সভাপতি মহাশয় শেপীরকে প্রমাণ করিয়া বয়কট নাম বয়কট করিবার পরামর্শ দিলেন, পাছে মরলী-মডারেটের মিলনমন্দিরে বিদ্বেষ-বহ্নি প্রবেশ করিয়া সব ভস্মসাৎ করে ৷ আর বােঝা গেল যে মধ্যপন্থী নেতাগণ বৈধ প্রতিরােধ পরিত্যাগ করিতে কৃতসঙ্কল্প ৷ বাস্তবিক মিলন যখন হইয়াছে, শাসন সংস্কার যখন গৃহীত হইয়াছে, তখন প্রতিরােধের আর আবশ্যকতা কোথায়? বিপক্ষে বিপক্ষে প্রতিরােধ সম্ভব, প্রেমিকে প্রেমিকে প্রার্থনা অভিমান ও ক্ষণিক মনােমালিন্যই শােভা পায় ৷ এই পুরাতন-নীতির পুনঃসংস্থাপনের ফল, নেতাগণ কভেন্সনকে আরও দৃঢ় করিয়া আলিঙ্গন করিয়া রহিয়াছেন, মাদ্রাজে বয়কট বর্জন করিলে সুরেন্দ্রনাথ কভেন্সন ত্যাগ করিবেন বলিয়া কয়েকজন যে আশা পােষণ করিয়াছিলেন, সেই আশা বিনষ্ট হইয়াছে ৷ কেবল একটী বিষয়ে এখনও সন্দেহ বৰ্ত্তমান, জাতীয় মহাসভার পুনঃসংস্থাপন সম্ভব না অসম্ভব? একপক্ষে প্রাদেশিক সমিতির অধিবেশনে দেখা গেল যে, সভায় কোন পূর্ণ জাতীয়ভাব প্রকাশক প্রস্তাব গৃহীত হইলে আমরা সমিতি ভাঙ্গিয়া সরিয়া পড়িব, ইহাই মধ্যপন্থীদিগের দৃঢ়সঙ্কল্প হইয়াছে ৷ তাহা যদি হয়, তবে প্রকৃত ঐক্য অসম্ভব ৷ ইহার তাৎপর্য কি? পূর্ণ রাজপুরুষ-ভক্তি-প্রকাশক কোনও প্রস্তাব উপস্থিত হইলে জাতীয় পক্ষ তাহা গ্রহণ করিতে বাধ্য, যত নিষ্ফল প্রার্থনা, প্রতিবাদ, নিবেদন গ্রহণ করিতে বাধ্য, কিন্তু পূর্ণ জাতীয় ভাবব্যঞ্জক প্রস্তাব গৃহীত হইতে পারে না ৷ এই সৰ্ত্তে কোন প্রবল ও বর্ধনশীল দল সমিতিতে থাকিতে সম্মত হইবে না, বিশেষতঃ যে দলের স্থায়ীভাবে সংখ্যাধিক্য হইয়াছে ৷ অপরপক্ষে জাতীয় পক্ষের নিৰ্বন্ধে দুই দলের একটী কমিটী নিযুক্ত হইয়াছে, জাতীয় মহাসভায় ঐক্য স্থাপন তাহার উদ্দেশ্য ৷ সভ্যদিগের চারিজন মধ্যপন্থী, শ্ৰীযুত সুরেন্দ্রনাথ, শ্ৰীযুত ভূপেন্দ্রনাথ বসু, শ্ৰীযুত বৈকুণ্ঠনাথ সেন, শ্ৰীযুত অম্বিকাচরণ মজুমদার এবং চারিজন জাতীয় পক্ষের শ্ৰীযুত অরবিন্দ ঘােষ, শ্ৰীযুত রজতনাথ রায়, শ্ৰীযুত জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্ৰীযুত কৃতান্তকুমার বসু ৷ ইহারা যদি একমত হইতে পারেন, তাহা হইলে জাতীয় মহাসভার ঐক্য সংস্থাপন চেষ্টাসাধ্য হইবে ৷ চেষ্টা করিলেও যে ঐক্য সাধিত হইবে, তাহাও বলা যায় না; কেন না যদি মেহতা ও গােখলে অসম্মত হয়েন অথবা বর্তমান ক্রীড ও কার্যপ্রণালী বিনা আপত্তিতে গ্রহণ করিতে বলেন, তাহা হইলে মধ্যপন্থী নেতাগণের পক্ষে তাহাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া জাতীয় মহাসভা সংস্থাপনে উদ্যোগী হওয়া অসম্ভব ৷
এই অবস্থায় একতা অসম্ভব, কিন্তু যে ক্ষীণ আশা এখনও বিদ্যমান, তাহাই জাতীয় পক্ষ ধরিয়া আছেন, সেই আশায় সংখ্যায় অধিক হইলেও তাহারা সৰ্ব্ব-বিষয়ে মধ্যপন্থীদের নিকট ইচ্ছা করিয়া হার মানিয়াছেন ৷ এইরূপ ত্যাগস্বীকার ও আত্মসংযম সকল পক্ষই দেখাইতে পারে ৷ যাঁহারা স্বীয় বল অবগত আছেন, তাঁহারা সর্বদা সেই বল প্রয়ােগ করিতে ব্যস্ত হয়েন না ৷ আমরা সুরাট অধিবেশনে ধৈৰ্য্যচ্যুত হইয়াছিলাম, বােম্বাইয়ের নেতাদিগের অন্যায় অবিচার ও অপমান সহ্য করিয়াও শেষে ধৈৰ্য্যভঙ্গে সেই আত্মসংযমের ফললাভ করিতে পারিলাম না, সেই দোষের প্রায়শ্চিত্তরূপে হুগলীতে প্রবল হইয়াও দুর্বল মধ্যপন্থীদলের সমস্ত আবদার সহ্য করিয়া একতার সেই ক্ষীণ আশা যাহাতে আমাদের দোষে বিনষ্ট হয়, সেই একমাত্র লক্ষ্য রাখিয়া প্রাদেশিক সমিতিকে অকাল মৃত্যর হস্ত হইতে রক্ষা করিলাম ৷ দেশের নিকট আমরা দোষমুক্ত হইলাম, ভবিষ্যৎ বংশীয়দের অভিশাপ মুক্ত হইলাম, ইহাই আমাদের আত্মসংযমের যথেষ্ট পুরস্কার ৷ মহাসভার একতা সাধিত হইবে কি চিরকালের জন্য বিনষ্ট হইবে, তাহা ভগবানের ইচ্ছাধীন, আমাদের নহে ৷ আমরা ক্ৰীড সহ্য করিব না, যে কাৰ্য্যপ্রণালী দেশের অনুমতি লইয়া প্রচলিত করা হইয়াছে, দেশের প্রতিনিধিগণ প্রকাশ্যসভায় তাহা গ্রহণ করা পর্যন্ত আমরাও গ্রহণ করিব না ৷ এই দুই বিষয়ে আমরা কৃতনিশ্চয়, কিন্তু তাহা ভিন্ন আমাদের পক্ষ হইতে কোনও বাধা হইবার সম্ভাবনা নাই ৷ বাধা যদি হয়, অপর পক্ষ হইতে হইবে ৷
কিন্তু আমরা এই ক্ষীণ আশার উপর নির্ভর করিয়া নিশ্চেষ্ট থাকিতে পারি না ৷কবে কোন্ অতর্কিত দুর্বিপাকে বঙ্গদেশের ঐক্য ছিন্নভিন্ন হইবে, তাহার কোন স্থিরতা নাই ৷ মহারাষ্ট্র, মাদ্রাজ, যুক্তপ্রদেশ ও পঞ্জাবের জাতীয় পক্ষ আমাদের মুখের দিকে চাহিয়া রহিয়াছেন ৷ বঙ্গদেশ ভারতের নেতা, বঙ্গদেশের দৃঢ়তা, সাহস ও কর্মকুশলতায় সমস্ত ভারতের উদ্ধার হইবে, নচেৎ হওয়া অসম্ভব ৷ অতএব আমরা জাতীয় দলকে আহ্বান করিতেছি, এখন কাৰ্য্যক্ষেত্রে আবার অবতরণ করি; ভয়, আলস্য, নিশ্চেষ্টতা দেশের জন্য উৎসর্গীকৃত প্রাণ সাধকদের সাজে , দেশময় জাতীয় ভাব প্রবলভাবে জাগ্রত হইতেছে, কিন্তু কর্মদ্বারা প্রকৃত আৰ্য্যসন্তান বলিয়া পরিচয় না দিতে পারিলে সেই জাগরণ, সেই প্রাবল্য, সেই ঈশ্বরের আশীর্বাদ স্থায়ী হইবে না ৷ ভগবান কর্মের জন্য, নবযুগ প্রবর্তনের জন্য, জাতীয় পক্ষকে সৃষ্টি করিয়াছেন ৷ এইবার কেবল উত্তেজনা ও সাহস নহে, ধৈৰ্য্য, সতর্কতা ও শৃঙ্খলা প্রয়ােজনীয় ৷ ভগবানের শক্তি বঙ্গদেশে ধীরে ধীরে অবতরণ করিতেছে; এবার সহজে তিরােহিত হইবে না ৷ অযাচিত ভাবে দেশসেবা করি, পরমেশ্বরের আশীৰ্বাদ আছে; হৃদয়স্থিত ব্রহ্ম জাগিয়াছেন, ভয় ও সন্দেহ উপেক্ষা করিয়া ধীরভাবে গন্তব্যপথে অগ্রসর হই ৷
Home
Sri Aurobindo
Books
Bengali
Share your feedback. Help us improve. Or ask a question.