CWSA Set of 37 volumes
Writings in Bengali and Sanskrit Vol. 9 of CWSA 715 pages 2017 Edition
Bengali
 PDF   

Editions

ABOUT

All writings in Bengali and Sanskrit including brief works written for the newspaper 'Dharma' and 'Karakahini' - reminiscences of detention in Alipore Jail.

Writings in Bengali and Sanskrit

Sri Aurobindo symbol
Sri Aurobindo

All writings in Bengali and Sanskrit. Most of the pieces in Bengali were written by Sri Aurobindo in 1909 and 1910 for 'Dharma', a Calcutta weekly he edited at that time; the material consists chiefly of brief political, social and cultural works. His reminiscences of detention in Alipore Jail for one year ('Tales of Prison Life') are also included. There is also some correspondence with Bengali disciples living in his ashram. The Sanskrit works deal largely with philosophical and cultural themes. (This volume will be available both in the original languages and in a separate volume of English translations.)

The Complete Works of Sri Aurobindo (CWSA) Writings in Bengali and Sanskrit Vol. 9 715 pages 2017 Edition
Bengali
 PDF   

বাংলা রচনা




পত্রাবলী




“প্রবর্তক” উদ্দেশ্যে লিখিত

সততং কীৰ্ত্তয়ন্তো তং যতন্তশ্চ দৃঢ়তাঃ ৷
নমস্যন্তশ্চ তং ভক্ত্যা নিত্যযুক্তা উপিসতে ॥

তচ্চিত্তা তৰ্গতপ্রাণা বােধয়ন্তঃ পরম্পরম্ ৷
কথয়ন্তশ্চ তং নিত্যং তুষ্যন্তি চ রমন্তি...

তাহা যতদূর হইতে পারিয়াছি, ততটুকু আমাদের সিদ্ধি ৷ সেই আদর্শ পূর্ণ করিতে পারি নাই, পারিব বলিয়া তাহার কথার উপর আস্থা স্থাপন করিয়া সাধনা করিতেছি ৷

তেষাং সততযুক্তানাং ভজতাং প্রীতিপূৰ্বক ৷
দদামি বুদ্ধিযােগং তং যেন মামুপন্তিতে ॥

পরকেও এ সাধনপথে ডাকিয়া আমাদের যে আস্থা, যে অনুভব, আর তার উপরেও যে Pisgah sight, পৰ্বত চূড়া হইতে promised landএর দর্শন মুক্তকণ্ঠে প্রচার করি ৷ আমাদের অনেকের এই অনুভব হইয়াছে ৷

স্বল্পমপ্যস্য ধৰ্ম্মস্য ত্রায়তে মহতাে ভয়াৎ ৷

যে একবিন্দু শক্তি হইয়াছে, তাহাতেই কৰ্ম্ম করিতে প্রবৃত্ত হই ৷ ফল ভগবানের হাতে কিন্তু এই পথের পুরা সিদ্ধির দূরের কথা ৷ এই পথ শুধু ব্যষ্টিযােগের, individual সিদ্ধির নয়, সমষ্টিযােগের, collective সিদ্ধির পন্থা, একজনের যদি ভগবৎকৃপায় পূর্ণযােগের সিদ্ধি হয়, তাহাকে সিদ্ধপুরুষ বলিব না ৷ এই পথ আরােহণের পথ, সিদ্ধির উপরেও সিদ্ধি আছে, শেষ পর্যন্ত না উঠিয়া উত্তম যােগারূঢ় না হইয়া সিদ্ধপুরুষ বলা আস্পর্ধা মাত্র ৷ আর আমরা miracle mongerও নই ৷Miracle আবার কি? যাহা হয় জগতে, সবই প্রকৃতির নিয়মের অন্তর্গত এক শক্তির খেলা, হয় miracle নাই, নয় all is miracle ৷তবে যে সাধারণ শক্তির উপর ঈশ্বরী শক্তির খেলা আছে, তাহা সত্য, সেই ভিতরের কথা, বাহিরের বুজরুকী নহে ৷ সেই ভগবানের ইচ্ছাশক্তি, ব্যক্তিগত শক্তি নয়, ভগবৎ-ইচ্ছা পূরণের উপায়, ব্যক্তির অহংকার স্ফুরণ, হৃদয়ের আবেগ, প্রাণের বাসনা বুদ্ধির অভিমত পূরণের নয় ৷

যাহা লিখিব তাহা পত্রপ্রেরকের মতখণ্ডনের জন্য নয়, সেই পত্রের কথা হইতে কয়েকটী সাধারণ প্রশ্ন উঠে, সাধকের মনেও কাচা অবস্থায় সন্দেহ বা ভ্রান্ত ধারণা জন্মিতে পারে, এই পত্রকে lead বা starting point করিয়া সেগুলির উত্তর দেওয়া, অপনােদন করাই উদ্দেশ্য ৷ তবে এক কথা বলিয়া রাখি ৷ ইংরাজী ভাষায় এই সকল কথার চর্চা অনেক দিন করিতেছি, —তুমি যে এখন বাঙ্গালা ভাষায় পুনরুক্তি করিবার আদেশ করিয়াছ, তাহা যেমন আমার উপর তেমনই পাঠকের [উপর] অত্যাচার ৷ তুমি বেশ জান শিক্ষা ও ঘটনার পরম্পরার দোষে, ইংরাজীতে লিখিবার ক্ষমতা কতকটা জন্মিয়াছে, বাঙ্গালা ভাষায় তাহা আমার নাই ৷ যদি মাতৃভাষার অঙ্গচ্ছেদ বা হত্যা পৰ্য্যন্ত করি, প্রবৰ্ত্তকের পৃষ্ঠাগুলি ইংরাজী বাঙ্গালায় কলুষিত করি সে দোষ আমার নয়, তােমার ৷ এই গেল অতি দীর্ঘ প্রস্তাবনা ৷ আসল কথা আরম্ভ করি ৷


পত্র

জিজ্ঞাসা করি, এই পত্রের উত্তর আমার নিকটে আদায় করিবার উদ্দেশ্য? তর্ক যদি করিতে হয়, তর্কের সাধারণ ভিত্তি (common ground) প্রয়ােজন, তাহার এখানে নিতান্ত অভাব ৷ চিন্তা করিবার প্রণালী স্বতন্ত্র, ভাবগত অনুভবে আলােক আঁধারের প্রভেদ ৷ অবশ্য পত্রলেখকেরই মনে আঁধার, আমার মনে আলােক, এই কথা বলি না ৷ কথার অর্থ এই, যে তাহার পক্ষে যা নিশা’ সেই যােগজ্ঞানের গভীর গুহায় আমার জাগরণ ও দর্শন হয়, যে বুদ্ধির দিবালােকে তিনি জাগেন ও দেখেন, আমার চক্ষে সেই আলােক ঘাের রাত্রী না হৌক, রাত্রীর অৰ্ধালােকিত প্রান্তভাগ, মিথ্যা আলােকের কুহক বােধ হয় ৷ তাহার নিকট যােগ-লব্ধজ্ঞান, যােগলব্ধ শক্তি প্রহেলিকা আত্মপ্রবঞ্চনা অজ্ঞান, আমার নিকট বুদ্ধির জ্ঞান প্রাণের আবেগময়ী আশাই অজ্ঞান, কুহক মরীচিকা, প্রহেলিকা, আত্মপ্রবঞ্চনা ৷

পত্রলেখক হয়ত য়ুরােপীয় বুদ্ধিপ্রধান শাস্ত্রের উপাসক ৷ যে মানুষী বুদ্ধির কল্যাণকর পরিণামে মনুষ্যজাতি অদ্য দলিত অধীর ক্ষতবিক্ষত, এই তিনি তাহারই জয়গানে উন্মত্ত শ্রীহক কি মহারবে না নভশ্চ পৃথিবীঞ্চৈব তুমুল অনুনাদিত করিয়া ভগবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণায় প্রবৃত্ত ৷ সিংহনাদং বিনদ্যোচ্চৈঃ শঙ্খং দমৌ প্রতাপবান্ ৷ এই ঘাের আক্রমণে মহাকাপুরুষ ভগবান যদি ভারত হইতে চিরকালতরে পলায়ন না করেন, মানুষী বুদ্ধির শক্তি বৃথা ৷ যদিও য়ুরােপীয় শাস্ত্র বলি, ওই শাস্ত্রে য়ুরােপের অদ্য আর সেই অটল বিশ্বাস বুদ্ধিবাদকে নাই ৷ কতকটা বুদ্ধিবাদের অসম্পূর্ণতা বুঝিয়া কতকটা তাহার অতিমাত্র সেবনের পরিণাম ভােগ করিয়া য়ুরােপ নূতন ভাবে ভাবুক, য়ুরােপ ভগবানকে খুঁজিতেছে ৷ ফ্রান্সে, ইংলণ্ডে আমেরিকায় দর্শনে কাব্যে চিত্রকলায় সঙ্গীতে কুড়ি ত্রিশ বৎসর ধরিয়া এই স্রোত চলিতেছে ৷ এখনও বটে অনেকে যে আঁধারে সেই আঁধারে, অনেকে হাতড়াইতেছে, অনেকে অস্পষ্ট কুয়াশায় নানা মূর্তি দেখিতেছে, আবার অনেকে দিবালােকে আলােকিত চক্ষুষ্মন ৷ স্রোত ত দেখি দিনদিন খরতর বেগে বহিতেছে ৷ এখনও য়ুরােপের ভুলে ভুক্তভােগী হই নাই, ভারতের নানা ভুলভ্রান্তির শােচনীয় পরিণামে অস্থির ৷ পত্রলেখক সেই অধীরতায় একদেশদর্শী কল্পনার বশে স্বপ্ন দেখিতেছেন, বুদ্ধির উপাসনায় যখন য়ুরােপ প্রবল সুখী (?) অধীশ্বর হইয়াছে, পরিণাম সেইখানে উত্থান, এইখানে পতন, আর যখন পরিণাম দেখিয়াই পথ পছন্দ করিতে হয়, ফলেন পরিচীয়তে, তখন আমরাও কেন সেই একপথে ছুটিব ? আপত্তি নাই ৷ ঢলুক না সকলে, দেশের যদি সেই অভিপ্রেত হয় ৷ অনেক গর্ভে পড়িয়া তাহার পর যদি জ্ঞান হয়, ঠিক পথে চলিতে শিখি ৷ মানুষী তনু আশ্রিত ভগবানকে অবমাননা করিয়া জ্ঞান কৰ্ম্মকে খাটো করিয়া যে গর্ভে পড়িলাম, তাহারই মধ্যে এখনাে ঘুরপাক খাইতেছি, না হয় বুদ্ধির বলে উঠিয়া অন্য যে গর্তে প্রাচীন গ্রীস রােম পড়িয়া মরিল, আধুনিক রুশ জৰ্ম্মণী পড়িয়াছে, কত প্রবল জাতি পড়িয়া পচিবে, আমরাও না হয় সেই গর্তে আছাড় খাইয়া সে সুখও উপভােগ করি, করি মার্দ্যকরী বুদ্ধিমদিরার সেবন – যাবৎ পততি ভূতলে, তাহার পরেও, যদি ইচ্ছা হয়, উত্থায়াপি পুনঃ নীত্বা তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদম্ ৷ শেষে জাতীয় নির্বাণপ্রাপ্তি লাভ করি ৷ আমরা কিন্তু যে সত্যের পথ অন্বেষণ করিয়া পাইয়াছি, সেই পথে দেশকে ডাকিতে বিরত হইব না ৷

যাক মতের বিরােধের কথা ৷ আমার মতে যদিও শ্রীহকের কথা ভ্রান্ত, অর্থাৎ বিকৃত সত্য, তথাপি বিকৃতির মধ্যেও সত্যের আভাস আছে ৷ তাহার মনের ভাব ও অবস্থা অতি স্বাভাবিক, হয়ত আজকাল ভারতে অনেকের অন্তরের সেই দশা ৷ তাহার প্রয়ােজনও ছিল ৷ এই কথা অন্যত্র অনেকবার লিখিয়াছি যে য়ুরােপের জড়বাদী নাস্তিকতারও একসময় আবশ্যকতা ছিল ধৰ্ম্মের কুমতি ভগবৎসম্বন্ধে ক্ষুদ্ৰভ্রান্ত ধারণা সজোরে বিনষ্ট করিবার জন্যে ৷ এখন যে আধ্যাত্মিক চিন্তা ও ধারণা য়ুরােপ আমেরিকাকে আলােকিত করিতেছে সেগুলি উদার মহৎ গভীর বেদান্তের সত্য প্লাবিত ৷ ক্ষেত্রকে বুদ্ধিবাদ বৈজ্ঞানিক জড়বাদ নাস্তিকতা পরিষ্কার করিয়া এই নূতন বীজ বপন করিবার অবসর দিয়াছে ৷ আমাদের মধ্যে পুরাণ অচলায়তন ভাঙ্গিবার আবশ্যকতা ছিল ৷ বুদ্ধিবাদী ইংরেজ শিক্ষা সেই কর্মের সহায়তা করিয়াছে, প্রকৃত পূর্ণ আধ্যাত্মিক সত্য পরিস্ফুট হইবার অবকাশ করা হইয়াছে ৷ প্রাচীন ভারতের শেষ অবস্থায় যােগে বৈরাগ্য নিশ্চেষ্টতা জীবন হইতে নিষ্কৃতির প্রয়াসে অতিমাত্র বৃদ্ধি, সংসারে নিস্তেজ ক্ষুদ্রাশয়তার লক্ষণ দেখি ৷ কিন্তু সেই ব্যাধির প্রকৃত ঔষধ বুদ্ধিবাদ নহে, জীবনেও বেদান্ত ধৰ্ম্মের পূর্ণতর আচরণ এই জ্ঞানই আমাদের সাধনা ও প্রচারের মূল মন্ত্র ৷

শ্রীহক সেই পথ মাড়াইতে চান না, বুদ্ধির বলেই দেশকে বলবান করিতে উৎসুক, আমার আপত্তি নাই, সবাই স্ব স্ব চিন্তা ও প্রেরণার স্রোতে কর্মে লাগুন ৷ সাক্ষাৎ কথা এই বুদ্ধিকেই যে প্রধান বলে তাহার পক্ষে যােগের কথা প্রহেলিকা আত্মপ্রবঞ্চনা ভিন্ন আর কিছুই নয় ৷ যােগের প্রথম ভিত্তি এই যে বুদ্ধির উপরে কিছু আছে, যাে বুদ্ধেঃ পরতস্তু সঃ ৷ বুদ্ধির বিকাশ ও বিশুদ্ধতা ত চাইই ৷ হয় প্রথম ভগবানকে বুদ্ধির বদ্ধ দ্বারের উদঘাটনে স্বধানপ্রতিষ্ঠিত দর্শন করিয়া, নয় হৃদয়ের গুপ্ত স্তরে অনুভব করিয়া তাহার পরে বুদ্ধির অতীত হই ৷ গীতায়ও বলে, এবং বুদ্ধেঃ পরং বুদ্ধা সংস্তভ্যাত্মানমাত্মনা ৷ যিনি বুদ্ধির উপরে, বুদ্ধি হইতে মহৎ বুদ্ধির সাহায্যেই তাহাকে বুঝিয়া smaller selfকে greater selfএর, ক্ষুদ্র আমিকে বড় আমির, মানুষের অহংকে অন্তরস্থ পরমাত্মা পুরুষােত্তমের বশ করা বিহিত ৷ বুদ্ধিবাদী ও আত্মবাদীর পথ বিভিন্ন, গতির নিয়ম শক্তি আস্থা স্বতন্ত্র, পথিকের ভাষাও স্বতন্ত্র ৷ আমি ও শ্রীহক দুইজনেই ভগবৎ শব্দ প্রয়ােগ করি, কিন্তু ভগবৎসম্বন্ধে তাহার বুদ্ধির ধারণা আর আমার অন্তরের অনুভব, এই দুইটীর বিন্দুমাত্র ঐক্য নাই ৷ শব্দ এক, অর্থ বিভিন্ন ৷ এই স্থলে তর্কের কি ৷ উপকার? তিনি যদি ইংরাজী আমি যদি ফরাসী লিখি, যেমন ফল হয়, এই ক্ষেত্রে সেই ফলই হওয়া সম্ভব ৷ তাহার ইংরাজী আমি বুঝিতে পারিব, আমার ফরাসী তিনি বুঝিবেন কেন ৷ তাহার মনের ভাব আমি বুঝি, মনুষ্য সাধারণের ভাব, আমারও একদিন সেই ধরনের চিন্তা তর্ক সন্দেহ যে হয় নি তাহা নহে, যখন আমিও বুদ্ধিবাদী নাস্তিক বা agnostic ছিলাম, ভগবানকে প্রত্যক্ষ করি নাই ৷ আমার যে ভাব ও প্রত্যক্ষ দর্শন (direct experience) তাহার হয় নাই, জিনিষটী যখন চেনেন না, যে ভাষায় তাহা ব্যক্ত হয়, তাহার পক্ষে শূন্য কল্পনার ভাষা মাত্র ৷ শ্রীহকের কল্পিত ভগবানকে মনুষ্যের মানসক্ষেত্র হইতে বিতাড়িত হন, আমার আপত্তি নাই, সত্য ভগবানকে কেহ বিতাড়িত করিবেন না, শ্রীহকও নয়, Voltaireও নয়, জড়বাদী বিজ্ঞানও নয় ৷ তিনি নাস্তিককেও চালান, আস্তিককেও চালান, তিনি সকলের অন্তর্যামী সৰ্বনিয়ন্তা ৷

এই পত্রের আর একটী আপদ যে আমরা যাহা বলি নাই, পত্রলেখক তাহাই জোর করিয়া আমাদের মুখে ওঁজাইয়া দেন, সেই কল্পিত মিথ্যা ভক্তিকেই ব্যঙ্গপূর্ণ তেজস্বী বাক্যস্রোতে ভাসাইয়া দিতে উদ্যত হন ৷ প্রথম তিনি বলেন, আত্মসমর্পণের অর্থ নিশ্চেষ্টতা, তােমাদের সাধন নিশ্চেষ্টতার সাধন, তাহা যদি হয়...

ধৈর্য্যের সহিত, সূক্ষ্মভাবে দার্শনিকের কথা বুঝিয়া নেওয়া আবশ্যক ৷ ক্ষুদ্রকায় প্ৰবৰ্ত্তকের ক্ষুদ্র প্রবন্ধে সেইরূপ পূর্ণ দার্শনিক বিচার সম্ভব নহে ৷ যােগপন্থা কিন্তু শুধু চিন্তার বিষয় নহে, আন্তরিক জীবনের অনুভবের বিষয় ৷ যেমন সাধারণ মনুষ্যজীবনে নানা বিরােধ ওঠে, যােগপন্থায়ও ততই বা ততােধিক বিরােধ বিঘ্ন প্রকট হয় ৷Provisional সামঞ্জস্য করি অনুভবে চিন্তা ও অন্তদৃষ্টির সাহায্যে, অবশেষে ভগবৎ আলােক বিস্তারে সব বিঘ্ন বিদূরিত হয়, সকল বিরােধী সত্যের প্রকৃত অর্থ ...* তাহাতেই সামঞ্জস্য আপনি আসিয়া পড়ে, বুদ্ধির চেষ্টা করিয়া আর মিলাইতে হয় না ৷ শ্রীহক কিন্তু যােগপ্রার্থী নয়, অন্তরের জীবনের দিকে তাহার লক্ষ্য নাই, ভারতের বাহিরের জীবনের দিকে ৷ আমাদের উদ্দেশ্য ও ...1 ভিতরের জীবন দ্বারা বাহিরের জীবন গড়া, to live from within outward, অবস্থার দাসত্ব না করিয়া বাহ্যিক ঘটনার বেগে পুতুল নাচ না করিয়া ভিতরের স্বারাজ্য সাম্রাজ্য দৃঢ় ভিত্তির উপর সংস্থাপন করা ৷ আমাদের বিশ্বাস দেশের যুবকগণ যদি এইরূপ ভিতরের স্বরাজ্য সাম্রাজ্য গঠন করিতে পারে, ভারতভূমি আবার অভ্রভেদী মহিমায় মস্তক উত্তোলন করিয়া সমস্ত জগৎকে স্বকীয় আলােকে শক্তিতে আনন্দে পূর্ণ ও প্লাবিত করিয়া দিবে ৷ ফলেন পরিচীয়তে, ফল কিন্তু একদিনেও হইবার নয়, কাচা অবস্থায়ও নয়, পূর্ণসিদ্ধির উপর নির্ভর করে ৷

আমাদের বিশ্বাস এইরূপ আধ্যাত্মিক জীবনের চেষ্টায় ভারত প্রাচীনকালে মহীয়ান হইয়া উঠিয়াছিল পরে অবনতির যুগেও সেই বলে সহস্র বিপদে বাঁচিয়াছে, য়ুরােপ এখন যে পৃথিবীতে ধৰ্ম্মরাজ্য ভগবাজ্য সংস্থাপন করিতে প্রয়াসী, এই পন্থায়ই সেই উদ্দেশ্য সংসিদ্ধ হইবে, বুদ্ধির অহঙ্কারের বলে নয় ৷ শ্রীহকের মতে এই বিশ্বাস নিতান্ত অসার শিশুর আরামদায়ক কল্পনা মাত্র ৷ তিনি বলেন ভারতের কেন্দ্রশক্তি কখন আধ্যাত্মিক জ্ঞান ছিল না, principleকে সম্মুখে রাখিয়া ঐশ্বৰ্য্য ত্যাগ করেন নাই, দৌর্বল্যে, আত্মরক্ষায় অসামর্থ্যে, তাহার পরে দায়ে ঠেকিয়া সন্ন্যাসী সাজিয়াছে ৷ ইতিহাসের অদ্ভুত ব্যাখ্যা বটে! ভারত সজ্ঞানে (consciously) টলস্টয়ের মত Resist no evil ইতি মহাবাক্যের শ্রদ্ধায় দুঃখদারিদ্র্য মহৎ করেনি ৷ “ভারতের অধ্যাত্মবিজ্ঞান ভূয়া মাত্র ৷ ইহা জীবনেতে পূর্ণমাত্রায় গঠন করিয়া তুলিতে অক্ষম ৷” আবার বলেন না কি, “Lloyd George, Dr. Wilsonএর মত এমন একটী লােকও ভারতে ছিল না যে একটা principleকে সম্মুখে রাখিয়া সকল ঐশ্বৰ্য্যকে ত্যাগ করিয়াছিল ৷” আমাদের আত্মসমর্পণ কথা শুনিয়া শ্রীহকের হাসি পায়, এই কথা শুনিয়া আমাদেরও হাস্য সম্বরণ করা কঠিন ৷ আমরা পাগল না হয় শিশুর মত অনেক অসার কথা বলি, কিন্তু তুমি বুদ্ধির উপাসক এই কি নিতান্ত বালকের মত উক্তি উদ্ধার করিলেন, শ্রীহক? প্রাচীন ভারতের আশ্রমপ্রথায় কি কোন principle ছিল না? বুদ্ধের ঐশ্বৰ্য্যত্যাগে principle ছিল না? দায়ে ঠেকিয়াই বুদ্ধ হইতে আরম্ভ করিয়া রামকৃষ্ণ পৰ্য্যন্ত সকলেই সন্ন্যাসী সাজিয়াছিলেন?

আসল কথা বলি ৷Resist no evil প্রাচীন বৌদ্ধদের জৈনদের principle ছিল, সমস্ত ভারতের নয় ৷ ভারতের প্রাচীন মতে দারিদ্র গ্রহণ করা, নিঃস্ব হওয়া সন্ন্যাসীর ধম্ম, সংসারীর ধৰ্ম্ম নয় ৷ ভারতের শাস্ত্র মনুষ্য জীবন চারিটী উদ্দেশ্য স্বীকার করিয়াছে, অর্থ কাম ধৰ্ম্ম মােক্ষ, য়ুরােপীয় শাস্ত্রেরও unformulated ভাবে অনেকদিন সেই চারিটীই ছিল, সে মনুষ্যস্বভাবের উপর প্রতিষ্ঠিত ৷ ইহা সত্য যে ভারতের সন্ন্যাসী যাহাই করুন জাতি ইচ্ছা করিয়া ঐশ্বৰ্য্যত্যাগ করেন ৷ নাই ৷ প্ৰবৰ্ত্তকের লেখক ভাবের উচ্ছ্বাসে এই কথা লিখিয়া ফেলিলেন যে ভারতবর্ষ যুগ যুগ ধরিয়া ইহজগতের সকল ঐশ্বর্য্যেই বঞ্চিত হইয়া রহিয়াছে, অত্যাচার সহ্য করিয়াছে – স্বেচ্ছায় নয়, দৈববিপাকে ৷ এই কথা অতিশয়ােক্তি, ঠিক সত্য নয় ৷ ভারতবর্ষ সেইদিন পৰ্য্যন্ত মহা ঐশ্বৰ্য্যশালী ছিল, মহা শক্তিমান ছিল ৷ হন ৷ শককে আত্মসাৎ করিয়া দুদিনে ফেলিয়াছিল, বর্বরকে সুসভ্য আধ্যাত্মিক ভাবসম্পন্ন করিতে পারিয়াছিল ৷ মুসলমান আসিয়াছে, তাহাতে ঐশ্বৰ্য্য কমে নাই ৷ বিজিত যদি বল দেখিবে য়ুরােপেও এমন দেশ নাই যে একসময় বিজেতার অধীনে ছিল না ৷ তবে ভারতের রাজনীতিক ঐক্যতার অভাবে বারবার সেই আক্রমণ সহ্য করিতে হইয়াছে, বারবার সামলাইয়া লইয়াছে হয় বিজিতকে আত্মসাৎ করিয়াছে ৷ নয় বােঝাপড়া করিয়া শান্তিতে বা যুদ্ধে, ইহা কম শক্তির লক্ষণ নহে ৷ অবশেষে অবসন্ন দুৰ্বল দরিদ্র হইয়া পড়ে – ঐশ্বৰ্য্যহীন বিবিধ দুর্দশাগ্রস্ত – এই দুই শতাব্দী ধরিয়া মাত্র, এখন আবার উঠিতেছে, ইংরেজ জাতির সঙ্গে বােঝাপড়া করিয়া স্বরাজের চেষ্টায় আছে ৷ আধ্যাত্মিক বলে নয় ত কোন শক্তিতে এতদিন বাঁচিয়াছে, বিপদের তরঙ্গে বারবার উঠিয়াছে বল দেখি? ভারতবাসী যিনিই বলুন ইংরেজই হউন, ভারতবাসীই হউন, কখন একথা স্বীকার করাে না যে আমরা হীন চিরপতিত গুণহীন জাতি ৷ সে কথা সত্য নহে, ডাহা মিথ্যা ৷

তাহার পর আধ্যাত্মিকতার কথা ৷ যিনি বলেন ভারতের প্রাচীন সভ্যতায় আধ্যাত্মিকতাকে principle করিয়া গঠিত হয়নি, তিনি হয় ভাল করিয়া study করেন নাই নয় আধ্যাত্মিকতা কি সেই সম্বন্ধে তাহার ধারণা ভ্রান্ত ৷ স্বীকার করি, ভারতে আধ্যাত্মিকতার ছাঁচে সমস্ত জীবনকে “পূর্ণ মাত্রায়” গঠন করিতে পারে নাই – কজন principleএর মত সমস্ত সত্তার অংশকে গঠন করিতে সমর্থ ৷ মনুষ্য অতি complex being, সেই জন্য জীবনের যত জটিলতা, সমস্যা, আত্মবিরােধ ৷ ইহাও স্বীকার করি সেই ন্যূনতা যত গলদের গােল ৷ এই আদর্শের যেমন মহাফল হয়, তেমনই মহাবিপদও হয়, ন্যূনতায় সহজে ভ্রংশ হয়, কিন্তু আবার শীঘ্র পুনরুত্থান হয় ৷ ইহাও স্বীকার করি যে শেষ অবস্থায় অতিমাত্র গলদ ছিল, মানুষী তনু আশ্রিত ভগবানকে অবমাননা, জ্ঞান কৰ্ম্মকে খাটো করা, যােগের জীবনের বিচ্ছেদ ও বিরােধ, ইত্যাদি ভুলভ্রান্তির অতিমাত্র বৃদ্ধি ৷ সেইজন্যেই ভারতের আধ্যাত্মবিজ্ঞানকে ভূয়া মাত্র বলা নিতান্ত অসার কথা, অল্প বা অধীর বুদ্ধির লক্ষণ ৷ আধ্যাত্মিকতার ঠিক পন্থা হারাইয়া ভারত দুর্দশাগ্রস্ত ৷ আধ্যাত্মিকতা জিনিসটা ভিতরে কখন হারায় নাই, সেই নিহিত শক্তিতে সমস্ত আক্রমণ বিপদ সহ্য করিয়া বাঁচিয়া রহিয়াছে, সেই শক্তিতে উঠিয়াছে ৷ প্রমাণ এই যে যেখানে যতবার উঠিয়াছে, সে আধ্যাত্মিকতার একটা নূতন তরঙ্গের মুখে, ইতিহাস তাহার সাক্ষী ৷ এইবারও যে উত্থান হইতেছে, আধ্যাত্মিকতার নূতন তরঙ্গই তাহার পূর্ব-চিহ্ন ছিল ৷ ইতিহাসকে যদি অস্বীকার কর, factকে যদি স্বমতের জোরে উড়াইয়া দাও, তাহা হইলে আর কথা নাই ৷

শ্রীহক য়ুরােপের দৃষ্টান্ত দেখান ৷ জিজ্ঞাসা করি মানুষী বুদ্ধির অনুশীলনে কোনও য়ুরােপীয় জাতি অমর হইয়াছে বা সহস্র সহস্র বৎসর বাঁচিয়াছে ৷ তিনি ৷ যদি বলেন যে আধ্যাত্মিকতায় ধুয়া ধরায় বুদ্ধিকে প্রধান না করায় ভারত অধঃ-পতিত, —স্বাধীন বুদ্ধির অনুশীলন কমিয়া যাওয়ায় ঢের ক্ষতি হইয়াছে, অস্বীকার করি না, আমি সে কথা বারবার লিখিয়াছি, – আমিও বলিতে পারি কেবল মানুষী বুদ্ধিকে প্রধান করিয়াই রােম গ্রীস মিশর, অসুর দেশ বাবিলােন মরিয়া গিয়াছে ৷ কিন্তু মানুষী বুদ্ধির প্রাবল্যে ইংলণ্ড-ফ্রান্স-আমেরিকা জৰ্ম্মণীকে জয় করিয়াছে, অতএব ভগবানকে তাড়াইয়া দাও, জয় মানুষী বুদ্ধির জয়! জিজ্ঞাসা করি জৰ্ম্মণীর কি বুদ্ধিবল, বুদ্ধির অনুশীলন ছিল না? যুদ্ধের প্রথম দিন পর্যন্ত জৰ্ম্মণীই এক শতাব্দী ধরিয়া য়ুরােপের গুরু, দর্শনে গুরু, বিদ্যায় গুরু, বুদ্ধিবাদের গুরু, জড়বাদের গুরু, Socialismএর গুরু, বিজ্ঞান তত্ত্ব অন্বেষণে তত না হােক বিজ্ঞান প্রয়ােগে গুরু ৷ সেইরূপ বুদ্ধিগঠিত শৃঙ্খলা নিরেট বন্ধন organisation, efficiency আর কোথাও ছিল না ৷ এই বুদ্ধিই যদি সৰ্বস্ব, হেন জৰ্ম্মণীর পতন হইয়াছে কেন ৷ যে ইংলণ্ড বদ্ধির ধার ধারে না, we somehow muddle through বলিয়া যাহার বড়াই, সে জয়ী হইয়াছে কেন, যে ফ্রান্সের চিরকলঙ্ক এই যে সাহসী বুদ্ধিমান সভ্যতার কেন্দ্র হইয়াও সে বিপদে টিকিতে পারে না, সেই বা এইবার টিকিয়াছে কেন, যে আমেরিকা সভ্যতার একপ্রান্তে পড়িয়াছিল, সে হঠাৎ জগতে idealismএর নেতা হইয়া উঠিয়াছে কেন ৷ কেবলই কি বুদ্ধির বলে?

জানি না শ্রীহক য়ুরােপের ভিতরের খবরের কথা রাখেন না কেবলই এই দেশের খবরের কাগজ পড়িয়া তাহার ধারণা গঠিত করেন! ইহা কি জানেন না যে বুদ্ধিবাদী য়ুরােপ আর বুদ্ধিবাদী নহে, ভারতের আধ্যাত্মিকতার সেইখানে আধিপত্য-কাল আরম্ভ হইয়াছে ৷ এই স্রোত কুড়ি ত্রিশ বৎসর ধরিয়া বহিতেছে – দর্শনে, চিন্তায়, কাব্যে, চিত্রে, সঙ্গীতে ৷ ইহা কি জানেন না যে, আমেরিকায় সৈনিক কি ধরণের চিঠি লেখেন, মাঝে মাঝে কবিতার উদগার করে ছত্রে ছত্রে ভগবানের কথা ভগবানের ভরসায় তাহারই শক্তিতে যুদ্ধ করার কথা ৷ আর সামান্য লেখক যে সব কবিতা লেখে, কেবলই অধ্যাত্ম, পুনর্জন্ম, সর্বজীবে ভগবদ্দর্শনের কথা ৷ ইংরেজ Wells সে দিন বুদ্ধির বলে আদর্শ সমাজ সংস্থাপন কথা লিখিয়াছেন, এখন কি লিখিতেছেন? “বুদ্ধির বলে হইবে না, অন্তরস্থ ভগবানকে জাগাইয়া দাও, উঠে পড়ি, ভগবানের সৈনিক হইয়া আত্মার বলে ভগবানের শক্তিতে পৃথিবীতে স্বর্গরাজ্য, ভগবাজ্য স্থাপন করি ৷” Noyesএর মত ইংরেজ কবিরাও সেই একই কথা লেখেন, ভগবানের রাজ্য ৷ শ্রীহক দেশ হইতে মহাকাপুরুষ ভগবানকে তাড়াইতে বলিতেছেন, য়ুরােপকে সেই কথা বলেন গিয়া! 2 শুধু আমরা যে স্বর্গরাজ্যের কথা বলিতেছি তাহা নয়, য়ুরােপের চিন্তানায়ক সেই সুর ধরিয়াছেন ৷ পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য একমত হইতেছেন ৷

এখন প্রশ্ন এই য়ুরােপ বুদ্ধিবাদ ছাড়িতেছে, আমরা কি ধরিব, অধ্যাত্মবিজ্ঞানের বলে, নয় বুদ্ধির বলেই বলীয়ান হইব? যদি অধ্যাত্মবিজ্ঞানের পূর্ণমাত্রায় জীবনকে গঠন করা শ্রেয়ঃ, তাহার প্রকৃত পন্থা কি? সেই আলােচনা পরে হইবে ৷


যে পত্র আমার নিকট পাঠাইয়াছ, পত্রলেখক [এর] মনের মত সন্তোষজনক উত্তর দেওয়া কঠিন ৷ লেখক বিক্ষিপ্ত চিন্তার উত্তেজনায় হৃদয়ের তীব্র আবেগে যে এলােমেলাে ভাবে নানান কথা জড়াইয়া দিয়াছেন, তাহার চিন্তার গতি যদি অনুসরণ করিতে যাই, সেই আবর্তে পড়িতে হয়, অথচ অন্য ভাবে অন্য দিক হইতে বিষয়টী ঠিক উত্তর দেওয়া হয় না ৷ তাহার উপর অল্পকথায় সমস্ত বিশ্বসমস্যা উত্থাপন! দুইচারিটী মােট কথায় বিশ্বসমস্যার মীমাংসা করা অসাধ্য, যদিও অল্প-কথায় উত্থাপন করা সহজ ৷ যেমন পারি, দুই কথায় সহজ ভাবে যাহা হয়, এই সকল প্রশ্ন ও আপত্তির উত্তর দিবার চেষ্টা করিব ৷ প্রথম একটা কথা না বলা চলে না ৷ লেখক মানুষী বুদ্ধির ক্ষণস্থায়ী ঐশ্বর্য্যে বিমুগ্ধ, বুদ্ধির বলে আস্থাবান বলবান হইতে চান ৷ বেশত, কিন্তু ইহাই যদি পন্থা, প্রথম বুদ্ধিকে ধীর স্থির শৃঙ্খলিত করিতে হয়, হৃদয়ের আবেগ উদ্বেগ বিক্ষেপে উদ্বেলিত চিন্তায় কোনও সমস্যা মীমাংসিত হয় না, জীবনের গতির কোনও স্থির পন্থাও পাওয়া যায় না ৷ য়ুরােপের বুদ্ধিবাদীও এই কথা জানেন ও বলেন যে হৃদয়দমনে মতের হঠকারিতা বর্জনে ৷ ক্ষুদ্র আমিকে নীরব করিয়া বিরাট সত্যকে দেখিতে হয় ৷ জগৎ দুঃখপূর্ণ বলিয়া চঞ্চল হওয়ার কোনও ফল নাই, স্থিরভাবে গলদ কোথায় দেখ, রােগের মূল কারণ নির্দেশ করিয়া ঔষধ ও পথ্য বিধেয় ৷ আর একটী অপ্রিয় কথা আমি বলিতে বাধ্য ৷ জাতি বা ব্যক্তি যদি জগতের সহস্র আঘাতে তিষ্ঠিতে চায়, ধীরভাবে দাড়াইতে হয় ৷ বিপদে আক্ষেপ অবর্ষণ কান্নার সুর নৈরাশ্য হাহাকার দৌর্বল্যের অক্ষমতার লক্ষণ ৷ ইহা হইতে বিপদকে “মূক ও বধিরের মত” নীরবে সহ্য করা সহস্রগুণ ভাল ৷ আত্মরক্ষা, সহ্য করা বা তিতিক্ষা, স্থিরতায় ক্ষমতায় স্বরাজ্য, আত্মশক্তিতে সাম্রাজ্য, এই হইল আত্মােন্নতির চারিটী ধাপ, বিশ্বরূপ বিদ্যালয়ের চারিটী পাঠ ৷ লেখক ভগবানকে “মহা কাপুরুষ” বলিয়াছেন, কিন্তু ভগবানের জগৎ বীরের দিগ্বিজয়ের রণক্ষেত্র ৷ জীবনের আকৃতি গতি স্থিতি দেখ, জড় হইতে আত্মতত্ত্ব পৰ্য্যন্ত ইহাই তাহার প্রথম ও শেষ শিক্ষা ৷ তিনি যদি সত্যই লক্ষ্য ও পথ ঠিক নির্দেশ করিয়া principle সম্মুখে রাখিয়া চলিতে চান, বুদ্ধির খেয়াল নয়, প্রাণের তরঙ্গরূপ অধীর উচ্ছ্বাস নয়, আগে স্থির ভাবে দেখুন, তাহার পর যে সত্যই পান, সেই principle পূর্ণ শ্রদ্ধার সহিত অনুসরণ করায় ফল হইবে ৷ বুদ্ধির অনন্তপথ, বুদ্ধিমান একপথ স্থির করিয়া লক্ষ্যের দিকে চলেন, এই ওই দিক ছুটিলে ব্যতিব্যস্তই হইতে হয়, কোথাও পচান যায় না ৷ ইহাই বুদ্ধির নিয়ম ৷

প্রবৰ্ত্তকের নির্দিষ্ট পথ স্বতন্ত্র, সে একা বুদ্ধির নহে, আত্মার ও সমগ্র সত্তার ৷ আমরা পূর্ণযােগের সাধক, ভগবানকে পূর্ণভাবে লাভ করিয়া জগতে দাড়াইতে চাই ৷ এই সাধনায় অনেক বিরােধের সামঞ্জস্য করা, অনেক জটিল সমস্যায় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া আবশ্যক ৷ তথাপি আমাদেরও একটী principle আছে, সেটীকে দৃঢ়ভাবে ধরিয়া চলি, সে কি তাহা পরে ব্যাখ্যা করিবার চেষ্টা করিব ৷ পত্রলেখক প্ৰবৰ্ত্তকে বিরােধের উক্তি দেখিয়া আমাদের উপর আক্রোশ করেন, বিরােধের সামঞ্জস্য দেখেন না, তাহার কারণ তিনি কেবল বহির্মুখী তার্কিক বুদ্ধির সাহায্যে বুঝিতে চান, আমরা কিন্তু আত্মজ্ঞান ও সাধনের দৃষ্টিতে দেখি, সেই ভাবে চলি ৷ আত্মবিরােধের একটী দৃষ্টান্ত দেন যে আমরা একস্থলে বলিয়াছি “যে যেখানে আছ, বসে পড়”, আর একস্থলে “ভগবান যে দিকে ছুটিয়ে চালান, যাও ৷” এখন যােগপথে বসিয়া পড়া যেমন সত্য, ছুটিয়া যাওয়াও সত্য ৷ সাধনের কথা, সাধনের নানা অবস্থা আছে ৷ প্রথম উক্তি একটী সাধারণ নিয়ম, শেষ উক্তি বিশেষ অবস্থায় খাটে ৷ সাধনের প্রথম অবস্থায় ভগবান চালান বটে, আমরা কিন্তু ছুটি অহংকারের, রাজসিক উত্তেজনার বেগে প্রেরণাকে বিকৃত করিয়া, তখন বসিবার আদেশ, নিশ্চেষ্টতার সাধন অনিবার্য হয় ৷ বরাবরই যদি সেই অশুদ্ধ মনে বিকৃত প্রেরণায় চলি, কোনও গভীর খাদে পড়িয়া হাড় ভাঙ্গান লাভই হইবে ৷ ভগবান ৷ যখন চালান, যাও, যখন বসাইয়া দেন, বসিয়া পড়, এই কথায় এমন কি বিরােধ আছে? যখন সিদ্ধির অবস্থা হইবে তখন এই বিকৃতির জঞ্জাল বিনষ্ট হইবে, তখন হয় অবিশ্রামে বরাবর ছুটিয়া যাইব, তাহাও ভগবানের ইচ্ছাশক্তি আদেশ ও প্রেরণার উপর নির্ভর করে ৷ আর তখনও সকল চেষ্টার পিছনে একটা মহতী নিশ্চেষ্টতা বিরাজ করিবে ৷ আত্মতত্ত্বের কথা, যােগের কথায় কেবলই তার্কিক বুদ্ধি লাগান চলে না ৷ তার্কিক বুদ্ধির হিসাবে উপনিষদের ভগবানকে এক সময়ই নিগুণ ও গুণী বলা বিরােধ দোষে দূষিত বর্ণনা, যেমন এক ফুল সুগন্ধি ও গন্ধহীন হইতে পারে না ৷ কিন্তু ভগবানের বেলায় তাহা খাটে না ৷ তিনি গুণের মধ্যে নির্গুণ, চেষ্টার মধ্যে নিশ্চেষ্ট, যেমন জমাট বরফের ঢাকা তরল জল ৷ বুদ্ধিমানের mechanical রূল করা কৰ্ম্মে ও সাধকের জীবন্ত আত্মগঠিত কৰ্ম্মেও সেই প্রভেদ ৷...


প্রথম পত্র সাধারণের জন্যে লিখি নাই, লিখেছিলাম তােমার পত্রের দুয়েকটী কথার উত্তরে ৷ আমাদের কাজের পথে অতি আবশ্যক ভেবে, বাঙ্গালীর কোথায় দোষত্রুটি কাৰ্যসিদ্ধির ব্যাঘাতের সম্ভাবনা তারই সম্বন্ধে কয়েকটী চিন্তা ব্যক্ত করেছিলাম সেই পত্রে ৷ বাঙ্গালীর কোনদিকে আশা, কোথায় তাহার বল ক্ষমতা কাৰ্যসিদ্ধির সামগ্রী, কিসেতে তার শক্তি নিহিত, সে সকল কথা লিখবার কোন প্রয়ােজন ছিল না ৷ সে ছিল সকলের জানা কথা, আমাদের উচ্চাশার ভিত্তি, আমাদের কর্ম প্রেরণার প্রধান সহায় ৷ বাঙ্গালীর জাগরণ মহত্ত্ব অশেষ poten-tiality উদার ভবিষ্যৎ লইয়া আমরা যে উচ্চ ধারণা ও উচ্চ আশা পােষণ কৰ্ত্তে সাহস করি, বাঙ্গালার ভবিষ্যতের যে উজ্জ্বল চিত্র মনের পটে অঙ্কিত হয়ে রয়েছে, সে এত উচ্চ এত উজ্জ্বল যে সে অত্যল্প লােকের কল্পনায়ও আসিতে পারে ৷ সে আশা দেশাভিমানীর মিথ্যা স্বপ্ন নয়, বাস্তবকে বীজরূপ দেখে ভাবী মহৎ বৃক্ষের আকৃতি নিরূপণ, actualকে চিনে possibleকে চেনা সেই কারণেই...


জাতির দোষ অভাবের সম্বন্ধে লিখেছি যাহা, তাহা তােমার কথার উত্তরে একটী দিক মাত্র, ছায়ার দিকটী মনে কর না যা এইটী এই বিষয়ে শেষ কথা ৷ সর্বদা সত্যের দুই দিক আছে, ছায়ার দিকটী দেখিয়ে দিলাম, আলাের দিকটী দেখতে হবে, তাহাই আসল ৷ তাহারই উপর বেশী জোর দেওয়া ভাল ৷Negativeটী দেখাতে হয়, ভিতরের দোষ অভাব মােচন করা দরকার শুদ্ধির জন্যে, positiveটী কিন্তু সিদ্ধির বীজ, আত্মার মূল capital, ভবিষ্যতে উন্নতির মুখ্য উপায় ৷…


মায়াবাদের কথা যখন আবার উঠিয়াছে, তাহার সম্বন্ধে দুয়েকটী মুখ্য কথা বিশদভাবে আলােচনা করা প্রয়ােজন বােধ করি ৷ সত্য কি অসত্য কি, নিত্য অনিত্য, সৎ অসৎ ইত্যাদি দুরূহ দার্শনিক তর্ক ছাড়িয়া দিলাম ৷ আসল কথা সহজ উদ্দেশ্য লইয়া, practical spiritual result, আধ্যাত্মিক চরম সিদ্ধি ও জগজ্জীবনের সঙ্গে তাহার সম্বন্ধ ও পরিণাম ৷ আমাদের কি মতের সিদ্ধান্ত মনােনীত, কি ভাবি, চিন্তার প্রণালী ও ধরণ গৌণ কথা, কি হই তাহাই মুখ্য ৷ আধ্যাত্মিক চিন্তা অধ্যাত্ম সিদ্ধির সহায় বলিয়া আদরণীয়, ভাবা হওয়ার উপায় বলিয়া মহৎ, শক্তির একটী প্রধান যন্ত্র ৷

প্ৰবৰ্ত্তকে মায়াবাদের বিরুদ্ধে অনেকবার লেখা হয়, এই পৰ্য্যন্ত সে গৌণভাবে হয়, মায়াবাদপ্রসূত কয়েকটী সাধারণ ভ্রান্তি আমাদের গন্তব্য পথে অন্তরায়রূপে পড়িয়া আছে, সেইগুলি অপসারিত করিবার অভিপ্রায়ে মােটামুটি কয়েকটী কথা ৷ এখন একজন প্রধান সন্ন্যাসী প্রচারক এই আক্রমণে ক্ষুব্ধ হইয়া সেই দার্শনিক শুষ্কবাদের আধুনিক একটী সরস (প্রবন্ধ) বাহির করিয়াছেন, এই অবসরে একটু বিস্তারিতভাবে আসল কথা বলা প্রয়ােজন হইল ৷ আর প্রথমে এই কথা আদবে উঠে কেন, তাহার কৈফিয়ৎ দরকার ৷ মায়াবাদের উপর আমাদের এত বিতৃষ্ণা কেন? বাদবিবাদের কি প্রয়ােজন, প্রত্যেকেই ভগবানের নিকট নিজের মনােনীত পথে যাইলেই হয়, ভগবান অনন্ত, তাহার নিকট পহুচিবার পথও অনন্ত ৷ অবশ্যই ব্যক্তিগত অধ্যাত্ম চর্চার বিষয়ে এই নিয়ম খাটে, কিন্তু এই বিষয় ব্যক্তিগত সাধনা লইয়া নয়, সমষ্টি লইয়া ৷ ভারতের জীবন, জগতের জীবন লইয়া ৷ মায়াবাদ শুধু সাধনায় একটী পন্থা নহে, তাহার হাত জগৎকে গ্রাস করিতে প্রসারিত ৷ তাহার প্রভাবের ছায়া সমস্ত জীবনের উপর ছাইয়া পড়িয়াছে – সেই ছায়ায় ভারতের জীবন শুকিয়া গিয়া আধমরা হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে ৷ তাহাকে আবার পুনরুজ্জীবিত বলবান পরিপুষ্ট সৰ্বাঙ্গসুন্দর করা প্রয়ােজন ৷ মায়াবাদের একমাত্র আধিপত্য ভাঙ্গিয়া দেওয়া প্রয়ােজন ৷


স্বামী সৰ্বানন্দের সকল যুক্তির উত্তর দেওয়ার প্রয়ােজন নাই ৷ এইরূপ বাদবিবাদে যে বিশেষ কোনও উপকার হয়, সেই বিশ্বাস আমার নাই, অথবা কোনও উপকার যদিও হয়, সে বুদ্ধির চতুঃসীমানায় নিবদ্ধ ৷ এইরূপ তর্ক, দার্শনিক যুক্তির তর্ক ও কথার কাটাকাটিতে বুদ্ধির সূক্ষ্ম বিচারের ক্ষমতা বৃদ্ধি হইতেও পারে, আত্মার স্ফূৰ্ত্তি কিন্তু সরস ও পূর্ণ না হইয়া খৰ্ব্ব হয়, শুকাইয়া যায় ৷ যাহা বাস্তব, যাহা প্রত্যক্ষ তাহা লইয়াই আত্মার অনুভূতির জীবন্ত বিস্তার ও উন্নতি ৷ তথাপি যখন কথাটী উঠিয়াছে, এই সকল যুক্তি তর্কে এক এক জনের কঁাচা বুদ্ধি বিচলিত হইতে পারে, এই সম্বন্ধে আমাদের যা বলিবার বলিয়া শেষ করা ভাল ৷

আমাদের বিশ্বাস বুদ্ধিপ্রসূত দর্শনে ভগবানকে, আত্মাকে পাওয়া যায় [না] ৷ দর্শনের আবশ্যকতা আছে সন্দেহ নাই, কিন্তু সেই দর্শন কল্যাণকর যে প্রকৃত দর্শন, দৃষ্টি, অনুভূতি, intuitionএ প্রতিষ্ঠিত ৷ তর্ক করিয়া যে সিদ্ধান্ত আমার মনােনীত তাহাই স্থাপন করিয়া একদিকদর্শী সত্যকে প্রতিপন্ন করা, ইহাই বুদ্ধি-প্রসূত দর্শনের নিয়ম...


মায়াবাদের আধিপত্য, মায়াবাদই ভারত আত্মার একমাত্র সত্য জ্ঞান অন্য সৰ্ববিধ দর্শন ও আধ্যাত্মিক অনুভূতি খণ্ড সত্য বা ভ্রান্তি, এই যে ধারণা – যাহা শংকরের সময় হইতে আজ পর্যন্ত আমাদের বুদ্ধিকে আক্রান্ত ও অভিভূত করিয়া রহিয়াছে, প্রবৰ্ত্তকে তাহার বিপক্ষে অনেকবার লেখা হইয়াছে ৷ সেইদিন প্রবৰ্ত্তকে সেই অর্থেই একটী ক্ষুদ্র প্রবন্ধ বাহির হইয়াছে; সেই প্রবন্ধ অবশ্য গভীর সূক্ষ্ম দার্শনিক তত্ত্ব তলাইয়া নহে, প্রশ্নর একটী দিক মাত্র লইয়া লেখা ৷ তাহারই প্রতিবাদে স্বামী সৰ্বানন্দ উদ্বোধনের আষাঢ়ের সংখ্যায় একটী দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখিয়া মায়াবাদকে সমর্থন করিয়াছেন ৷ দার্শনিক বাদবিবাদে আমরা প্রায়ই সময় নষ্ট করিতে ...3 অনিচ্ছুক ৷ প্রথমতঃ প্ৰবৰ্ত্তকের আকার ক্ষুদ্র, দার্শনিক বাগবিতণ্ডার শেষ নাই, সম্যক রূপে এই যুক্তি ওই যুক্তির নিরসন খণ্ডন সমর্থন প্রতিষ্ঠা করিতে যদি হয়, আমাদের আসল উদ্দেশ্য সিদ্ধ করিবার অবসর থাকা কঠিন ৷ মায়াবাদের সম্বন্ধেও আমরা শুধু কয়েকটী মােট কথা বলিয়া সন্তুষ্ট ছিলাম তাহাও কেবল এই কারণে বলিতে হইল, যে আধুনিক ভারতের মনে ওই দার্শনিক মতের ছাপ, মায়াবাদের একাধিপত্য পূর্ণযােগের প্রধান অন্তরায় হইয়া দাড়াইয়াছে, সেই সম্বন্ধে দুয়েকটী কথা না বলা চলে না ৷ আমাদের উদ্দেশ্য মানুষের সমস্ত সত্তা জাগাইয়া আধ্যাত্মিক জ্ঞানে আলােকিত করিয়া আত্মানুভূতিতে ভরিয়া ভগবৎ-চিন্তায় জ্যোতির্ময় করিয়া মানুষের সকল বৃত্তি ভগবানের সাযুজ্যে সালােকে সামীপ্যে সাধৰ্মে ভগবভাবে প্রতিষ্ঠিত করিয়া দেশকে জগৎকে মনুষ্য জীবনের প্রকৃত উন্নতি সম্পূর্ণতা সংসিদ্ধির দিকে প্রণােদিত করা ৷ মায়াবাদ যদি একান্ত একমাত্র সত্য হয়, এই চেষ্টা পণ্ডশ্রম মাত্র ৷ একই উপায় থাকে, কৌপীন বা গেরুয়া বস্ত্র পরিয়া অরণ্যে পৰ্বতে গুহায় বা মঠে বসিয়া – কিন্তু মঠস্থাপনও যে অজ্ঞান ভেল্কী মায়া, তাহা ভুলিতে নাই – লয়ের, মােক্ষের তীব্র পরিশ্রম ৷ যদি এই একমাত্র সত্য অর্থে আমরা অসমর্থ, যতদিন সামর্থ্য না হয় মায়ার মধ্যে রহিয়াই সকল দুঃখ ক্লেশ দেশের দারিদ্র অবনতি মাথায় করিয়া কোনরকম বাঁচিয়া থাকা আর সবই মায়া জগৎ মিথ্যা চেষ্টা মিথ্যা এই মন্ত্র] আওড়াইতে আওড়াইতে ওই একমাত্র সত্য জ্ঞানকে অবাধ্য মনে জাগ্রত করা বুদ্ধিমানের শ্রেষ্ঠ পন্থা ৷









Let us co-create the website.

Share your feedback. Help us improve. Or ask a question.

Image Description
Connect for updates