CWSA Set of 37 volumes
Writings in Bengali and Sanskrit Vol. 9 of CWSA 715 pages 2017 Edition
Bengali
 PDF   

Editions

ABOUT

All writings in Bengali and Sanskrit including brief works written for the newspaper 'Dharma' and 'Karakahini' - reminiscences of detention in Alipore Jail.

Writings in Bengali and Sanskrit

Sri Aurobindo symbol
Sri Aurobindo

All writings in Bengali and Sanskrit. Most of the pieces in Bengali were written by Sri Aurobindo in 1909 and 1910 for 'Dharma', a Calcutta weekly he edited at that time; the material consists chiefly of brief political, social and cultural works. His reminiscences of detention in Alipore Jail for one year ('Tales of Prison Life') are also included. There is also some correspondence with Bengali disciples living in his ashram. The Sanskrit works deal largely with philosophical and cultural themes. (This volume will be available both in the original languages and in a separate volume of English translations.)

The Complete Works of Sri Aurobindo (CWSA) Writings in Bengali and Sanskrit Vol. 9 715 pages 2017 Edition
Bengali
 PDF   

বাংলা রচনা




কাহিনী ও কবিতা




স্বপ্ন

একটী দরিদ্র লােক অন্ধকার কুরীতে বসিয়া নিজ শােচনীয় অবস্থা এবং ভগবানের রাজ্যে অন্যায় ও অবিচারের কথা ভাবিতেছিল ৷ দরিদ্র অভিমানের বশীভূত হইয়া বলিতে লাগিল, “লােকে কর্মের দোহাই দিয়া ভগবানের সুনাম বাঁচাইতে চায় ৷ গত জন্মের পাপে যদি আমার এই দুর্দশা হইত, আমি যদি এতই পাপী হইতাম, তাহা হইলে নিশ্চয় এই জন্মে আমার মনে পাপ চিন্তার স্রোত এখনও বহিত, এত ঘাের পাতকীর মন কি একদিনে নিৰ্ম্মল হয়? আর ওই পাড়ার তিনকড়ি শীল, তাহার যে ধনদৌলত স্বর্ণরৌপ্য দাসদাসী, কৰ্ম্মফল সত্য হইলে নিশ্চয়ই পূৰ্ব্ব জন্মে তিনি জগদ্বিখ্যাত সাধু মহাত্মা ছিলেন, কিন্তু কই তাহার চিহ্নমাত্রও এই জন্মে দেখি না ৷ এমন নিষ্ঠুর পাজী বদমায়েশ জগতে নাই ৷ না, কৰ্ম্মবাদ ভগবানের ফঁাকি, মনভুলান কথা মাত্র ৷ শ্যামসুন্দর বড় চতুর চূড়ামণি, আমার কাছে ধরা দেন না, তাই রক্ষা – নচেৎ উত্তম শিক্ষা দিয়া সব চালাকী বাহির করিতাম ৷” এই কথা বলিবামাত্র দরিদ্র দেখিল হঠাৎ তাহার অন্ধকার ঘর অতিশয় উজ্জ্বল আলােকতরঙ্গে ভাসিয়া গেল, অল্পক্ষণ পরে আলােকতরঙ্গ অন্ধকারে মিলাইয়া গেল, আর সে দেখিল তাহার সম্মুখে একটী সুন্দর কৃষ্ণবর্ণ বালক প্রদীপ হাতে দাড়াইয়া রহিয়াছে – মৃদু হাসিতেছে, কিন্তু কোনও কথা কহিতেছে না ৷ ময়ূরপুচ্ছ ও পায়ে নূপুর দেখিয়া দরিদ্র বুঝিল স্বয়ং শ্যামসুন্দর আসিয়া তাহাকে ধরা দিয়াছেন ৷ দরিদ্র অপ্রতিভ হইল, একবার ভাবিল প্রণাম করি, কিন্তু বালকের হাসিমুখ দেখিয়া কিছুতেই প্রণাম করিবার প্রবৃত্তি হইল না, – শেষে মুখ হইতে এই কথাই বাহির হইয়া গেল, “ওরে কেষ্টা, তুই এলি কেন?” বালক হাসিয়া কহিল, “কেন, তুমি আমাকে ডাকিলে না? এইমাত্র আমাকে চাবুক মারিবার প্রবল বাসনা তােমার মনে ছিল ৷ তা, ধরা দিলাম, উঠিয়া চাবকাও না ৷” দরিদ্র আরও অপ্রতিভ হইল, ভগবানকে চাবুক মারিবার ইচ্ছার জন্য অনুতাপ নহে, কিন্তু স্নেহের পরিবর্তে এমন সুন্দর বালকের গায়ে হাত লাগানটা ঠিক রুচিসঙ্গত বলিয়া বােধ হইল না ৷ বালক আবার বলিল, “দেখ হরিমােহন, যাহারা আমাকে ভয় না করিয়া সখার মত দেখে, স্নেহভাবে গাল দেয়, আমার সঙ্গে খেলা করিতে চায়, তাহারা আমার বড় প্রিয় ৷ আমি খেলার জন্যই জগৎ সৃষ্টি করিয়াছি, সর্বদা খেলার উপযুক্ত সঙ্গী খুঁজিতেছি ৷ কিন্তু, ভাই, পাইতেছি না ৷ সকলে আমার উপর ক্রোধ করে, দাবী করে, দান চায়, মান চায়, মুক্তি চায়, ভক্তি চায়, কই আমাকে ত কেহ চায় না ৷ যাহা চায়, আমি দিই ৷ কি করিব সন্তুষ্টই করিতে হয়, নহিলে আমাকে ছিড়িয়া খাইবে ৷ তুমিও দেখিতেছি, কিছু চাও ৷ বিরক্ত হইয়া চাবকাইবার লােক চাও, আমাকে সেই সাধ মিটাইবার জন্য ডাকিয়াছ ৷ চাবুকের প্রহার খাইতে আসিয়াছি – যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে ৷ তবে যদি প্রহারের আগে আমার মুখে শুনিতে চাও, আমার প্রণালী বুঝাইয়া দিব ৷ কেমন রাজী আছ?” হরিমােহন বলিল, “পারিবি ত? দেখিতেছি বড় বকিতে জানিস, কিন্তু তাের মত কচি ছেলে যে আমাকে কিছু শিখাইতে পারিবে, তাহা বিশ্বাস করিব কেন?” বালক আবার হাসিয়া বলিল, “এস, দেখ, পারি কিনা ৷”

এই বলিয়া শ্রীকৃষ্ণ হরিমােহনের মাথায় হাত দিলেন ৷ তখনই দরিদ্রের সৰ্ব্ব শরীরে বিদ্যুতের স্রোত খেলিতে লাগিল, মূলাধারে সুপ্ত কুণ্ডলিনী শক্তি অগ্নিময়ী ভূজঙ্গিনীর আকারে গৰ্জন করিয়া ব্ৰহ্মরন্ধ্রে ছুটিয়া আসিল, মস্তিষ্ক প্রাণশক্তির তরঙ্গে ভরিয়া গেল ৷ পর মুহূর্তে হরিমােহনের চারিধারে ঘরের দেওয়াল যেন দূরে পলাইতে লাগিল, নামরূপময় জগৎ যেন তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া অনন্তে ৷ লুক্কায়িত হইল ৷ হরিমােহন বাহ্যজ্ঞানশূন্য হইল ৷ যখন আবার চৈতন্য হইল, সে দেখিল কোন অচেনা বাড়ীতে বালকের সঙ্গে দাড়াইয়া আছে, সম্মখে গদীতে বসিয়া গালে হাত দিয়া একজন বৃদ্ধ প্রগাঢ় চিন্তায় নিমগ্ন রহিয়াছেন ৷ সেই ঘাের দুশ্চিন্তাবিকৃত হৃদয়বিদারক নিরাশাবিমর্ষ মুখমণ্ডল দেখিয়া হরিমােহন বিশ্বাস করিতে চায় নাই যে এই বৃদ্ধ গ্রামের হর্তাকর্তা তিনকডি শীল ৷ শেষে অতিশয় ভীত হইয়া বালককে বলিল, “কি করিলি কেষ্টা, চোরের মত ঘাের রাত্রীতে পরের বাড়ীতে ঢুকিলি? পুলিস আসিয়া ধরিয়া প্রহারের চোটে দুইজনের প্রাণ বাহির করিবে যে! তিনকড়ি শীলের প্রতাপ জানিস না?” বালক হাসিয়া বলিল, “খুব জানি ৷ কিন্তু চুরি আমার পুরাতন ব্যবসা, পুলিসের সঙ্গে আমার বেশ ঘনিষ্ঠতা আছে, ভয় নাই ৷ এখন তােমাকে সূক্ষ্মদৃষ্টি দিলাম, বৃদ্ধের মনের ভিতর দেখ ৷ তিনকড়ির প্রতাপ জান, আমার প্রতাপও দেখ ৷” তখন হরিমােহন বৃদ্ধ তিনকড়ির মন দেখিতে পাইল ৷ দেখিল, যেন শত্ৰু-আক্রমণে বিধ্বস্ত ধনাঢ্যানগরী, সেই তীক্ষ্ণ ওজস্বিনী বুদ্ধিতে কত ভীষণমূৰ্ত্তি পিশাচ ও রাক্ষস প্রবেশ করিয়া শান্তি বিনাশ করিতেছে, ধ্যান ভঙ্গ করিতেছে, সুখ লুণ্ঠন করিতেছে ৷ বৃদ্ধ প্রিয় কনিষ্ঠপুত্রের সঙ্গে কলহ করিয়াছেন, তাড়াইয়া দিয়াছেন; বৃদ্ধকালের স্নেহের পুত্রকে হারাইয়া শােকে ম্রিয়মাণ, অথচ ক্রোধ, গৰ্ব্ব, হঠকারিতা হৃদয়দ্বারে অর্গল দিয়া শান্ত্রী হইয়া বসিয়া আছে ৷ ক্ষমার প্রবেশ নিষেধ করিতেছে ৷ কন্যার নামে দুশ্চরিত্রা বলিয়া কলঙ্ক রটিয়াছে, বৃদ্ধ তাঁহাকে বাড়ী হইতে তাড়াইয়া প্রিয়কন্যার জন্য কাদিতেছেন; বৃদ্ধ জানেন সে নির্দোষ, কিন্তু সমাজের ভয়, লােকলজ্জা, অহঙ্কার, স্বার্থ স্নেহকে চাপিয়া ধরিয়াছে ৷ সহস্র পাপের স্মৃতিতে বৃদ্ধ ভীত হইয়া বারবার চমকিয়া উঠিতেছে, তথাপি পাপ প্রবৃত্তির সংস্কারে সাহস বা বল নাই ৷ মাঝে মাঝে মৃত্যু ও পরলােকের চিন্তা বৃদ্ধকে অতি নিদারুণ বিভীষিকা দেখাইতেছে ৷ হরিমােহন দেখিল, মরণ-চিন্তার পশ্চাৎ হইতে বিকট যমদূত কেবলই উঁকি মারিতেছে ৷ ও কপাটে ঠক্ ঠক্ করিতেছে ৷ যতবার এইরূপ শব্দ হয় বৃদ্ধের অন্তরাত্মা ভয়ে উন্মত্ত হইয়া চীৎকার করিয়া উঠে ৷ এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখিয়া হরিমােহন আতঙ্কে বালকের দিকে চাহিয়া বলিল, “এ কিরে কেষ্টা, আমি ভাবিতাম বৃদ্ধ পরম সুখী ৷” বালক বলিল, “ইহাই আমার প্রতাপ ৷ বল দেখি কাহার প্রতাপ বেশী, ও-পাড়ার তিনকড়ি শীলের, না বৈকুণ্ঠবাসী শ্রীকৃষ্ণের? দেখ, হরিমােহন আমারও পুলিস আছে, পাহারা আছে, গবর্ণমেণ্ট আছে, আইন আছে, বিচার আছে, আমিও রাজা সাজিয়া খেলা করিতে পারি, এই খেলা কি তােমার ভাল লাগে?” হরিমােহন বলিল, “না বাবা ৷ এ ত বড় বদ খেলা ৷ তাের বুঝি ভাল লাগে?” বালক হাসিয়া বলিল, “আমার সব খেলা ভাল লাগে, চাবকাইতেও ভালবাসি, চাবুক খাইতেও ভালবাসি!” তাহার পর বলিল, “দেখ হরিমােহন তােমরা কেবল বাহিরটা দেখ, ভিতরটা দেখিবার সূক্ষ্মদৃষ্টি এখনও বিকাশ কর নাই ৷ সেইজন্যই বল, তুমি দুঃখী, আর তিনকড়ি সুখী ৷ এই লােকটীর কোনই পার্থিব অভাব নাই – অথচ তােমার অপেক্ষা এই লক্ষপতি কত অধিক দুঃখযন্ত্রণা ভােগ করিতেছে ৷ কেন, বলিতে পার? মনের অবস্থায় সুখ, মনের অবস্থায় দুঃখ ৷ সুখ দুঃখ মনের বিকার মাত্র ৷ যাহার কিছু নাই বিপদই যাহার সম্পত্তি, ইচ্ছা করিলে সে বিপদের মধ্যেও পরম সুখী হইতে পারে ৷ আবার দেখ তুমি যেমন নীরস পুণ্যে দিন কাটাইয়া সুখ পাইতেচ্ছ ৷ না, কেবল দুঃখ চিন্তা করিতেছ, ইনিও সেইরূপ নীরস পাপে দিন কাটাইয়া কেবলই দুঃখ চিন্তা করেন ৷ তাই পুণ্যের ক্ষণিক সুখ বা পাপের ক্ষণিক দুঃখ বা পুণ্যের ক্ষণিক দুঃখ পাপের ক্ষণিক সুখ ৷ এই দ্বন্দ্বে আনন্দ নাই ৷ আনন্দ-আগারের ছবি আমার কাছে; আমার কাছে যে আসে, যে আমার প্রেমে পড়ে, আমাকে সাধে, আমার উপর জোর করে, অত্যাচার করে – সে আমার আনন্দের ছবি আদায় করে ৷” হরিমােহন আগ্রহপূর্বক শ্রীকৃষ্ণের কথা শুনিতে লাগিল ৷ বালক আবার বলিল, “আর দেখ হরিমােহন, শুষ্ক পুণ্য তােমার নিকট নীরস হইয়া পড়িয়াছে অথচ সংস্কারের প্রভাব তুমি ছাড়িতে পার না; সেই তুচ্ছ অহঙ্কার জয় করিতে পার না ৷ বৃদ্ধের নিকট পাপ নীরস হইয়া পড়িয়াছে অথচ সংস্কারের প্রভাবে তিনিও তাহা ছাড়িতে না পারিয়া – ইহজীবনে নরকযন্ত্রণা ভােগ করিতেছেন ৷ ইহাকে পুণ্যের বন্ধন, পাপের বন্ধন বলে ৷ অজ্ঞানজাত সংস্কার সেই বন্ধনের রঞ্জু ৷ কিন্তু বৃদ্ধের এই নরকযন্ত্রণা বড় শুভ অবস্থা ৷ তাহাতে তাঁহার পরিত্রাণ ও মঙ্গল হইবে ৷”

হরিমােহন এতক্ষণ নীরবে কথা শুনিতেছিল, এখন বলিল, “কেষ্টা, তাের কথা বড় মিঠে, কিন্তু আমার প্রত্যয় হইতেছে না ৷ সুখ দুঃখ মনের বিকার হইতে পারে, কিন্তু বাহ্যিক অবস্থা তাহার কারণ ৷ দেখ, ক্ষুধার জ্বালায় যখন মন ছটফট করে, কেহ কি পরম সুখী হইতে পারে? অথবা যখন রােগে বা যন্ত্রণায় শরীর কাতর হয়, তখন কি কেহ তাের কথা ভাবিতে পারে?” বালক বলিল, “এস, হরিমােহন, তাহাও তােমাকে দেখাইব ৷” এই বলিয়া বালক আবার হরিমােহনের মাথায় হাত দিল, স্পর্শ অনুভব করিবামাত্র হরিমােহন দেখিল আর তিনকড়ি শীলের বাড়ী নাই, নির্জন সুরম্য পৰ্ব্বতের বায়ুসেবিত শিখরে একজন সন্ন্যাসী আসীন, ধ্যানে মগ্ন, চরণ প্রান্তে প্রকাণ্ড ব্যাঘ্র প্রহরীর ন্যায় শায়িত ৷ ব্যাঘ্র দেখিয়া হরিমােহনের চরণদ্বয় অগ্রসর হইতে নারাজ হইল, কিন্তু বালক তাহাকে টানিয়া সন্ন্যাসীর নিকট লইয়া গেল ৷ বালকের সঙ্গে জোরে না পারিয়া হরিমােহন অগত্যা চলিল ৷ বালক বলিল, “দেখ হরিমােহন ৷ হরিমােহন চাহিয়া দেখিল, সন্ন্যাসীর মন তাহার চক্ষের সামনে খােলা খাতার মত রহিয়াছে, তাহার পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় শ্রীকৃষ্ণনাম সহস্রবার লেখা ৷ সন্ন্যাসী নির্বিকল্প সমাধির সিংহদ্বার পার হইয়া সূৰ্য্যালােকে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে ক্রীড়া করিতেছেন ৷ আবার দেখিল, সন্ন্যাসী অনেকদিন অনাহারে রহিয়াছে, গত দুই দিন শরীর ক্ষুৎপিপাসায় বিশেষ কষ্ট পাইয়াছে ৷ হরিমােহন বলিল, “এ কিরে কেষ্টা? বাবাজী তােকে এত ভালবাসেন, অথচ ক্ষুৎপিপাসা ভােগ করিতেছেন ৷ তাের কি কোন কাণ্ডজ্ঞান নাই! এই নির্জন ব্যাঘ্ৰসঙ্কুল অরণ্যে কে তঁাহারে আহার দিবে!” বালক বলিল, “আমি দিব, কিন্তু আর এক মজা দেখ ৷” হরিমােহন দেখিল, ব্যাঘ্র উঠিয়া তাহার থাবার এক প্রহারে নিকটবর্তী বল্মীক ভাঙ্গিয়া দিল ৷ ক্ষুদ্র শত শত পিপীলিকা বাহির হইয়া ক্রোধে সন্ন্যাসীর গায়ে উঠিয়া দংশন করিতে লাগিল ৷ সন্ন্যাসী ধ্যানমগ্ন, নিশ্চল, অটল ৷ তখন বালক সন্ন্যাসীর কর্ণকুহরে অতি মধুর স্বরে একবার ডাকিল, “সখে!” সন্ন্যাসী চক্ষু উন্মীলন করিলেন ৷ প্রথমে মােহ-জ্বালাময় দংশন অনুভব করেন না, তখনও কর্ণকুহরে সেই বিশ্ববাঞ্ছিত চিত্তহারী বংশীরব বাজিতেছে – যেমন বৃন্দাবনে রাধার কানে বাজিয়াছিল ৷ তাহার পরে শত শত দংশনে বুদ্ধি শরীর দিকে আকৃষ্ট হইল ৷ সন্ন্যাসী নড়িলেন না – সবিস্ময়ে মনে মনে বলিতে লাগিলেন, “এ কি? আমার এমন ত কখনও হয় নাই ৷ যাক্ শ্রীকৃষ্ণ আমার সঙ্গে ক্রীড়া করিতেছেন, ক্ষুদ্র পিপীলিকাচয়রূপে আমাকে দংশন করিতেছেন ৷” হরিমােহন দেখিল, দংশনের জ্বালা বুদ্ধিতে আর পৌঁছে না, প্রত্যেক দংশনে তিনি তীব্র শারীরিক আনন্দ অনুভব করিয়া কষ্ণনাম উচ্চারণপৰ্ব্বক অধীর আনন্দে হাততালি দিয়া নত্য করিতে লাগিলেন ৷ পিপীলিকাগুলি মাটিতে পড়িয়া পলাইয়া গেল ৷ হরিমােহন সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিল, “কেষ্টা, এ কি মায়া!” বালক হাততালি দিয়া দুইবার এক পায়ের উপর ঘুরিয়া উচ্চহাস্য করিল, “আমিই জগতের একমাত্র যাদুকর! এ মায়া বুঝিতে পারিবে না, এই আমার পরম রহস্য ৷ দেখিলে? যন্ত্রণার মধ্যেও আমাকে ভাবিতে পারিলেন ত! আবার দেখ ৷” সন্ন্যাসী প্রকৃতিস্থ হইয়া আবার বসিলেন; শরীর ক্ষুৎপিপাসা ভােগ করিতে লাগিল, কিন্তু হরিমােহন দেখিল সন্ন্যাসীর বুদ্ধি সেই শারীরিক বিকার অনুভব করিতেছে মাত্র, কিন্তু তাহাতে বিকৃত বা লিপ্ত হইতেছে না ৷ এই সময়ে পাহাড় হইতে কে বংশীবিনিন্দিত স্বরে ডাকিল, “সখে!” হরিমােহন চমকিল ৷ এ যে শ্যামসুন্দরেরই মধুর বংশীবিনিন্দিত স্বর ৷ তাহার পরে দেখিল, শিলাচয়ের পশ্চাৎ হইতে একটী সুন্দর কৃষ্ণবর্ণ বালক থালায় উত্তম ৷ আহার ও ফল লইয়া আসিতেছে ৷ হরিমােহন হতবুদ্ধি হইয়া শ্রীকৃষ্ণের দিকে চাহিল ৷ বালক তাহার পার্শ্বে দাড়াইয়া আছে, অথচ যে বালক আসিতেছে, সেও অবিকল শ্রীকৃষ্ণ ৷ অপর বালক আসিয়া সন্ন্যাসীকে থালা দেখাইয়া বলিল, “দেখ, কি এনেছি ৷সন্ন্যাসী হাসিয়া বলিলেন, “এলি? এতদিন না খাওয়াইয়া রাখিলি যে? যাক, এলি ত বােস, আমার সঙ্গে খা ৷” সন্ন্যাসী ও বালক সেই থালার খাদ্য খাইতে বসিল, পরস্পরকে খাওয়াইতে লাগিল, কাড়াকাড়ি করিতে লাগিল ৷ আহার শেষ হইলে বালক থালা লইয়া অন্ধকারে মিশিয়া গেল ৷

হরিমােহন কি জিজ্ঞাসা করিতে যাইতেছিল, হঠাৎ দেখিল শ্রীকৃষ্ণ আর নাই, সন্ন্যাসীও নাই, ব্যাঘ্রও নাই, পৰ্বতও নাই ৷ সে একটী ভদ্র পল্লীতে বাস করিতেছে; বিস্তর ধনদৌলত আছে, স্ত্রী-পরিবার আছে, রােজ ব্রাহ্মণকে দান করিতেছে, ভিক্ষুককে দান করিতেছে, ত্রিসন্ধ্যা করিতেছে, শাস্ত্রোক্ত আচার সযত্নে রক্ষা করিয়া রঘুনন্দন-প্রদর্শিত পথে চলিতেছে, আদর্শ পিতা, আদর্শ স্বামী, আদর্শ পুত্র হইয়া জীবনযাপন করিতেছে ৷ কিন্তু পর মুহূর্তে ভীত হইয়া দেখিল যে যাহারা সে ভদ্র-পল্লীতে বাস করে, তাহাদের মধ্যে লেশমাত্র সদ্ভাব বা আনন্দ নাই, যন্ত্রবৎ বাহিরের আচার রক্ষাকেই পুণ্য জ্ঞান করিতেছে ৷ প্রথমটা হরিমােহনের যেমন আনন্দ হইয়াছিল, এখন তেমনই যন্ত্রণা হইতে লাগিল ৷ তাহার বােধ হইল যেন তাহার বিষম তৃষ্ণা লাগিয়াছে, কিন্তু জল পাইতেছে না, ধূলি খাইতেছে, কেবলই ধূলি কেবলই ধূলি অনন্ত ধূলি খাইতেছে ৷ সেই স্থান হইতে পলায়ন করিয়া সে আর এক পল্লীতে গেল, সেখানে একটী প্রকাণ্ড অট্টালিকার সম্মুখে অপূৰ্ব জনতা ও আশীর্বাদের রােল উঠিতেছিল ৷ হরিমােহন অগ্রসর হইয়া দেখিল, তিনকড়ি শীল দালানে বসিয়া সেই জনতার মধ্যে অশেষ ধন বিতরণ করিতেছেন, কেহই নিরাশ হইয়া ফিরিতেছে ৷ না ৷হরিমােহন উচ্চহাস্য করিল, সে ভাবিল, “একি স্বপ্ন! তিনকড়ি শীল আবার দাতা?” তাহার পরে সে তিনকড়ির মন দেখিল ৷ বুঝিল, সেই মনে লােভ, ঈর্ষা, কাম, স্বার্থ ইত্যাদি সহস্র অতৃপ্তি ও কুপ্রবৃত্তি দেহি দেহি রব করিতেছে ৷ তিনকড়ি পুণ্যের খাতিরে, যশের খাতিরে, গর্বের বশে সেই ভাবগুলি ছাপাইয়া রাখিয়াছেন, অতৃপ্ত রাখিয়াছেন, চিত্ত হইতে তাড়াইয়া দেন নাই ৷ এই সময় আবার কে হরিমােহনকে ধরিয়া তাড়াতাড়ি পরলােক ভ্রমণ করাইয়া আনিল ৷ হরিমােহন হিন্দুর নরক, খৃষ্টানের নরক, মুসলমানের নরক, গ্রীকদের নরক, হিন্দুর স্বর্গ, খৃষ্টানের স্বর্গ, মুসলমানের স্বর্গ, গ্রীকদের স্বর্গ, আর কত নরক, কত স্বর্গ দেখিয়া আসিল ৷ তাহার পরে দেখিল, সে নিজ বাড়ীতে পরিচিত হেঁড়া মাদুরে ময়লা তােষকে ভর দিয়া বসিয়া আছে সম্মুখে শ্যামসুন্দর ৷ বালক বলিল, “বড় রাত্রী হইয়াছে, বাড়ীতে না ফিরিলে সকলে আমাকে বকিবে, মারামারি আরম্ভ করিবে ৷ সংক্ষেপে বলি ৷ যে স্বর্গ নরক দেখিলে, সে স্বপ্নজগতের, কল্পনাসৃষ্ট ৷ মানুষ মরিলে স্বর্গ নরকে যায়, গত জন্মের ভাব অন্যত্র ভােগ করে ৷ তুমি পূর্বজন্মে পণ্যবান ছিলে, কিন্ত প্রেম তােমার হৃদয়ে স্থান পায় নাই, না তুমি ঈশ্বরকে ভালবাসিয়াছ, না মানুষকে ৷ প্রাণত্যাগের পরে স্বপ্নজগতে সেই ভদ্রপল্লীতে বাস করিয়া পূর্বজীবনের ভাব ৷ ভােগ করিতে লাগিলে, ভােগ করিতে করিতে সে ভাব আর ভাল লাগে না, প্রাণ আকুল হইতে লাগিল, সেখান হইতে গিয়া ধূলিময় নরকে বাস করিলে, শেষে জীবনের পুণ্যফল ভােগ করিয়া আবার তােমার জন্ম হইল ৷ সেই জীবনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৈমিত্তিক দান ভিন্ন, নীরস বাহ্যিক ব্যবহার ভিন্ন কাহারও অভাব দূর করিবার জন্য কিছু কর নাই বলিয়া এই জন্মে তােমার এত অভাব ৷ আর এখনও যে নীরস পুণ্য করিতেছ, তাহার কারণ এই যে, কেবল স্বপ্নজগতের ভােগে পাপ পুণ্য সম্পূর্ণ ক্ষয় হয় না, পৃথিবীতে কৰ্ম্মফল ভােগে ক্ষয় হয় ৷ তিনকড়ি গতজন্মে দাতাকর্ণ ছিলেন, সহস্র ব্যক্তির আশীর্বাদে এই জন্মে লক্ষপতি ও অভাবশূন্য হইয়াছেন, কিন্তু চিত্তশুদ্ধি হয় নাই বলিয়া অতৃপ্ত কুপ্রবৃত্তি এখন পাপ দ্বারা তৃপ্ত করিতে হইয়াছে ৷ কৰ্ম্মবাদ বুঝিলে কি? পুরস্কার বা শাস্তি নহে – কিন্তু অমঙ্গলের দ্বারা অমঙ্গল সৃষ্টি, এবং মঙ্গল দ্বারা মঙ্গল সৃষ্টি ৷ ইহা প্রাকৃতিক নিয়ম ৷ পাপ অশুভ, তাহা দ্বারা দুঃখ সৃষ্ট হয়; পুণ্য শুভ, তাহার দ্বারা সুখ সৃষ্ট হয় ৷ এই ব্যবস্থা চিত্তশুদ্ধির জন্য, অশুভ বিনাশের জন্য ৷ দেখ হরিমােহন, পৃথিবী আমার বৈচিত্র্যময় জগতের অতি ক্ষুদ্র অংশ, কিন্তু সেখানে কর্ম দ্বারা অশুভ বিনাশ করিবার জন্য তােমরা জন্মগ্রহণ কর ৷ যখন পাপ-পণ্যের হাত হইতে পরিত্রাণ পাইয়া প্রেমরাজ্যে পদার্পণ কর, তখন এই কাৰ্য্য হইতে অব্যাহতি পাও ৷ পরজন্মে তুমিও অব্যাহতি পাইবে ৷ আমি আমার প্রিয় ভগিনী শক্তি ও তাহার সহচরী বিদ্যাকে তােমার কাছে পাঠাইব, কিন্তু দেখ, এক সৰ্ত্ত আছে, তুমি আমার খেলার সাথী হইবে, মুক্তি চাইতে পারিবে না ৷ রাজি?” হরিমােহন বলিল, “কেষ্টা, তুই আমাকে গুণ করিলি! তােকে কোলে লইয়া আদর করিতে বড় ইচ্ছা করে, যেন এই জীবনে আর কোন বাসনা নাই ৷”

বালক হাসিয়া বলিল, “হরিমােহন, কিছু বুঝিলে?” হরিমােহন বলিল, “বুঝিলাম বই কি ৷” তাহার পরে একটু ভাবিয়া বলিল, “ওরে কেষ্টা আবার ফাকি দিলি ৷ অশুভ সৃজন করিলি কেন, তাহার ত কোন কৈফিয়ৎ দিস্ নি ৷” এই বলিয়া সে বালকের হাত ধরিল ৷ বালক হাত কাড়িয়া লইয়া হরিমােহনকে শাসাইয়া বলিল, “দুর হ! এক ঘণ্টার মধ্যে আমার সব গুপ্ত কথা বাহির করিয়া লইবি?” বালক হঠাৎ প্রদীপ নিবাইয়া সরিয়া সহাস্যে বলিল, “কই, হরিমােহন, চাবক মারিতে একেবারে ভুলিয়া গেলে যে! সেই ভয়ে তােমার কোলে বসিলাম না, কখন বাহ্যিক দুঃখে চটিয়া আমাকে উত্তম শিক্ষা দিবে! তােমার উপর আমার লেশমাত্র বিশ্বাস নাই ৷” হরিমােহন অন্ধকারে হাত বাড়াইল, কিন্তু বালক আরও সরিয়া বলিল, “না, সে সুখ তােমার পরজন্মের জন্য রাখিলাম ৷ আসি ৷” এই বলিয়া অন্ধকার রজনীতে বালক কোথায় অদৃশ্য হইয়া গেল ৷ হরিমােহন নূপুরধ্বনি শুনিতে শুনিতে জাগিয়া উঠিল ৷ জাগিয়া ভাবিল, “এ কি রকম স্বপ্ন দেখিলাম! নরক দেখিলাম, স্বর্গ দেখিলাম, তাহার মধ্যে ভগবানকে তুই বলিলাম, ছােট ছেলে বুঝিয়া কত ধমক দিলাম ৷ কি পাপ! যা হােক, প্রাণে বেশ শান্তি অনুভব করিতেছি ৷” হরিমােহন তখন কৃষ্ণবর্ণ বালকের মােহনমূৰ্ত্তি ভাবিতে বসিল এবং মাঝে মাঝে বলিতে লাগিল, “কি সুন্দর! কি সুন্দর!”









Let us co-create the website.

Share your feedback. Help us improve. Or ask a question.

Image Description
Connect for updates