All writings in Bengali and Sanskrit including brief works written for the newspaper 'Dharma' and 'Karakahini' - reminiscences of detention in Alipore Jail.
All writings in Bengali and Sanskrit. Most of the pieces in Bengali were written by Sri Aurobindo in 1909 and 1910 for 'Dharma', a Calcutta weekly he edited at that time; the material consists chiefly of brief political, social and cultural works. His reminiscences of detention in Alipore Jail for one year ('Tales of Prison Life') are also included. There is also some correspondence with Bengali disciples living in his ashram. The Sanskrit works deal largely with philosophical and cultural themes. (This volume will be available both in the original languages and in a separate volume of English translations.)
প্রস্তাবনা
গীতা জগতের শ্রেষ্ঠ ধৰ্ম্মপুস্তক ৷ গীতায় যে জ্ঞান সংক্ষেপে ব্যাখ্যাত হইয়াছে, সেই জ্ঞান চরম ও গুহ্যতম, গীতায় যে ধৰ্ম্মনীতি প্রচারিত, সকল ধৰ্ম্মনীতি সেই নীতির অন্তর্নিহিত এবং তাহার উপর প্রতিষ্ঠিত, গীতায় যে কর্মপন্থা প্রদর্শিত, সেই কর্মপন্থা উন্নতিমুখী জগতের সনাতন মার্গ ৷
গীতা অযুতরত্নপ্রসূ অতল সমুদ্র ৷ সমস্ত জীবনকাল সেই সমুদ্রের নিম্নস্তরে অবতরণ করিতে করিতেও গভীরতার অনুমান করা যায় না, তল পাওয়া যায় না ৷ শত বৎসর খুঁজিতে খুঁজিতে সেই অনন্ত রত্নভাণ্ডারের সহস্রাংশ ধনও আহরণ করা দুষ্কর ৷ অথচ দু-একটী রত্ন উদ্ধার করিতে পারিলে দরিদ্র ধনী হন, গভীর চিন্তাশীল জ্ঞানী, ভগবদবিদ্বেষী প্রেমিক, মহাপরাক্রমী শক্তিমান কৰ্ম্মবীর তাহার জীবনের উদ্দেশ্যসাধনের জন্য সম্পূর্ণরূপে সজ্জিত ও সন্নদ্ধ হইয়া কৰ্ম্মক্ষেত্রে ফিরিয়া আসেন ৷
গীতা অক্ষয় মণির আকর ৷ যুগে যুগে আকরস্থ মণি যদি সংগ্রহ করা যায়, তথাপি ভবিষ্যৎ বংশধরগণ সৰ্ব্বদা নূতন নূতন অমূল্য মণিমাণিক্য লাভ করিয়া হৃষ্ট ও বিস্মিত হইবেন ৷
এইরূপ গভীর ও গুপ্তজ্ঞানপূর্ণ পুস্তক অথচ ভাষা অতিশয় প্রাঞ্জল, রচনা সরল, বাহ্যিক অর্থ সহজবােধগম্য ৷ গীতাসমুদ্রের অনুচ্চ তরঙ্গের উপরে উপরে বেড়াইলেও, ডুব না দিলেও, কতক শক্তি ও আনন্দ বৃদ্ধি হয় ৷ গীতারূপ আকরের রত্নোদ্দীপিত অন্ধকারের ভিতর প্রবেশ না করিয়া চারিপার্শ্বে বেড়াইলেও তৃণের মধ্যে পতিত উজ্জ্বল মণি পাওয়া যায়, ইহজীবনের তরে তাহাই লইয়া ধনী সাজিতে পারিব ৷
গীতার সহস্র ব্যাখ্যা হইলেও এমন সময় কখনও আসিবে না যখন নূতন ব্যাখ্যার প্রয়ােজন হইবে না ৷ এমন জগৎশ্রেষ্ঠ মহাপণ্ডিত বা গভীর জ্ঞানী গীতার ব্যাখ্যা করিতে পারেন না যে তাহার ব্যাখ্যা হৃদয়ঙ্গম হইলে বলিতে পারি, হইয়াছে, ইহার পরে আর গীতার ব্যাখ্যা করা নিষ্প্রয়ােজন, সমস্ত অর্থ বােঝা গেল ৷ সমস্ত বুদ্ধি খরচ করিয়া এই জ্ঞানের কয়েকদিক মাত্র বুঝিতে ও বুঝাইতে পারিব, বহুকাল যােগমগ্ন হইয়া বা নিষ্কাম কৰ্ম্মমার্গে উচ্চ হইতে উচ্চতর স্থানে আরূঢ় হইয়া এই পর্যন্ত বলিতে পারিব যে গীতােক্ত কয়েকটী গভীর সত্য উপলব্ধি করিলাম বা গীতার দু-একটী শিক্ষা ইহজীবনে কার্যে পরিণত করিলাম ৷ লেখক যেটুকু উপলব্ধি করিয়াছেন, যেটুকু কৰ্ম্মপথে অভ্যাস করিয়াছেন, বিচার ও বিতর্ক দ্বারা তদনুযায়ী যে অর্থ করিয়াছেন, তাহা অপরের সাহায্যার্থ বিবৃত করা এই প্রবন্ধগুলির উদ্দেশ্য ৷
বক্তা
গীতার উদ্দেশ্য ও অর্থ বুঝিতে হইলে পূৰ্বে বক্তা, পাত্র ও তখনকার অবস্থার কথা বিচার করা প্রয়ােজন ৷ বক্তা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, পাত্র তাহার সখা বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুন, অবস্থা কুরুক্ষেত্রের ভীষণ হত্যাকাণ্ডের আরম্ভ ৷
অনেকে বলেন, মহাভারত রূপক মাত্র, শ্রীকৃষ্ণ ভগবান, অর্জুন জীব, ধাত্ত-রাষ্ট্রগণ রিপুসকল, পাণ্ডবসেনা মুক্তির অনুকূল বৃত্তি ৷ ইহাতে যেমন মহাভারতকে কাব্যজগতে হীন স্থান দেওয়া হয়, তেমনই গীতার গভীরতা, কর্মীর জীবনে ৷ উপযােগিতা ও উচ্চ মানবজাতির উন্নতিকারক শিক্ষা খৰ্ব্ব ও নষ্ট হয় ৷ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ কেবল গীতাচিত্রের ফ্রেম নয়, গীতােক্ত শিক্ষার মূল কারণ এবং গীতােক্ত ধৰ্ম্ম সম্পাদনের শ্রেষ্ঠ ক্ষেত্র ৷ কুরুক্ষেত্র মহাযুদ্ধের কাল্পনিক অর্থ যদি স্বীকার করা যায়, গীতার ধর্ম বীরের ধর্ম, সংসারে আচরণীয় ধৰ্ম্ম না হইয়া সংসারের অনুপযােগী শান্ত সন্ন্যাস ধৰ্ম্মে পরিণত হয় ৷
শ্রীকৃষ্ণ বক্তা ৷ শাস্ত্রে বলে শ্রীকৃষ্ণ ভগবান স্বয়ং ৷ গীতায়ও শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে ভগবান বলিয়া খ্যাপন করিয়াছেন ৷ চতুর্থ অধ্যায়ে অবতারবাদ এবং দশম অধ্যায়ে বিভূতিবাদ অবলম্বন করিয়া ভগবান সৰ্ব্বভূতের দেহে প্রচ্ছন্নভাবে অধিষ্ঠিত, বিশেষ বিশেষ ভূতে শক্তিবিকাশে কতক পরিমাণে ব্যক্ত এবং শ্রীকৃষ্ণদেহে পূর্ণাংশরূপে অবতীর্ণ, ইহাই প্রচারিত হইয়াছে ৷ অনেকে বলেন, শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন কুরুক্ষেত্র রূপকমাত্র, সেই রূপক বর্জন করিয়া গীতার আসল শিক্ষা উদ্ধার করিতে হয়, কিন্তু সেই শিক্ষার এই অংশ বাদ দিতে পারি না ৷ অবতারবাদ যদি থাকে, শ্রীকৃষ্ণকে বাদ দিব কেন? অতএব স্বয়ং ভগবান এই জ্ঞান ও শিক্ষার প্রচারক ৷
শ্রীকৃষ্ণ অবতার, মানবদেহে মনুষ্যের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক ধর্ম গ্রহণ করিয়া তদনুসারে লীলা করিয়া গিয়াছেন ৷ সেই লীলার প্রকাশ্য ও গূঢ় শিক্ষা যদি আয়ত্ত করিতে পারি, এই জগদ্ব্যাপী লীলার অর্থ, উদ্দেশ্য ও প্রণালী আয়ত্ত করিতে পারিব ৷ এই মহতী লীলার প্রধান অঙ্গ পূর্ণজ্ঞানপ্রবর্তিত কৰ্ম্ম, সেই কর্মের মধ্যে ও সেই লীলার মূলে কি জ্ঞান নিহিত ছিল, গীতায় তাহা প্রকাশিত হইল ৷
মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণ কর্মবীর, মহাযােগী, মহাসংসারী, সাম্রাজ্যস্থাপক, রাজনীতিবিদ ও যােদ্ধা, ক্ষত্রিয়দেহে ব্রহ্মজ্ঞানী ৷ তাঁহার জীবনে মহাশক্তির অতুলনীয় বিকাশ ও রহস্যময় ক্রীড়া দেখি ৷ সেই রহস্যের ব্যাখ্যা গীতা ৷
শ্রীকৃষ্ণ জগৎপ্রভু, বিশ্বব্যাপী বাসুদেব, অথচ স্বীয় মহিমা প্রচ্ছন্ন করিয়া পিতা, পুত্র, ভ্রাতা, পতি, সখা, মিত্র, শত্রু ইত্যাদি সম্বন্ধ মানবদিগের সঙ্গে স্থাপন করিয়া লীলা করিয়াছেন ৷ তাঁহার জীবনে আৰ্যজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ রহস্য এবং ভক্তিমার্গের উত্তম শিক্ষা নিহিত আছে ৷ ইহার তত্ত্বগুলিও গীতােক্ত শিক্ষার অন্তর্গত ৷
শ্রীকৃষ্ণ দ্বাপর ও কলিযুগের সন্ধিস্থলে অবতীর্ণ হইয়াছেন ৷ কল্পে কল্পে সেই সন্ধিস্থলে ভগবান পূর্ণাংশরূপে অবতীর্ণ হন ৷ কলিযুগ চতুর্যুগের মধ্যে যেমন নিকৃষ্ট তেমনই শ্রেষ্ঠ যুগ ৷ সেই যুগ মানবােন্নতির প্রধান শত্রু পাপপ্রবর্তক কলির রাজ্যকাল; মানবের অত্যন্ত অবনতি ও অধােগতি কলির রাজ্যকালে হয় ৷ কিন্তু বাধার সহিত যুদ্ধ করিতে করিতে শক্তিবৃদ্ধি হয়, পুরাতনের ধ্বংসে নতনের সৃষ্টি হয়, কলিযুগেও সেই নিয়ম দেখা যায় ৷ জগতের ক্রমবিকাশে অশুভের যেই অংশ বিনাশ হইতে যাইতেছে, তাহাই কলিযুগে অতিবিকাশে নষ্ট হয়, এই দিকে নতনের বীজ বপিত ও অঙ্কুরিত হয়, সেই বীজই সত্যযুগে বৃক্ষে পরিণত হয় ৷ উপরন্তু যেমন জ্যোতিষবিদ্যায় একটী গ্রহের দশায় সকল গ্রহের অন্তর্দশা ভােগ হয়, তেমনই কলির দশায় সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি নিজ নিজ অন্তর্দশা বারবার ভােগ করে ৷ এইরূপ চক্রগতিতে কলিযুগে ঘাের অবনতি, আবার উন্নতি, আবার ঘােরতর অবনতি, আবার উন্নতি হইয়া ভগবানের অভিসন্ধি সাধিত হয় ৷ দ্বাপর কলির সন্ধিস্থলে ভগবান অবতীর্ণ হইয়া অশুভের অতিবিকাশ, অশুভের নাশ, শুভের বীজবপন ও অঙ্কুরপ্রকাশের অনুকূল অবস্থা করিয়া যান, তাহার পরে কলির আরম্ভ হয় ৷ শ্রীকৃষ্ণ এই গীতার মধ্যে সত্যযুগানয়নের উপযােগী গুহ্য জ্ঞান ও কর্মপ্রণালী রাখিয়া গিয়াছেন ৷ কলির সত্য অন্তর্দশার আগমনকালে গীতাধৰ্ম্মের বিশ্বব্যাপী প্রচার অবশ্যম্ভাবী ৷ সেই সময় উপস্থিত বলিয়া গীতার আদর কয়েকজন জ্ঞানী ও পণ্ডিতদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকিয়া সর্বসাধারণে এবং ম্লেচ্ছদেশেও প্রসারিত হইতেছে ৷
অতএব বক্তা শ্রীকৃষ্ণ হইতে তাহার গীতারূপ বাক্য স্বতন্ত্র করা যায় না ৷ শ্রীকৃষ্ণ গীতায় প্রচ্ছন্ন হইয়া রহিয়াছেন, গীতা শ্রীকৃষ্ণের বাঙময়ী মূর্তি ৷
পাত্র
গীতােক্ত জ্ঞানের পাত্র পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ মহাবীর ইন্দ্রতনয় অর্জুন ৷ যেমন বক্তাকে বাদ দিলে গীতার উদ্দেশ্য ও নিগুঢ় অর্থ উদ্ধার করা কঠিন, তেমনই পাত্রকে বাদ দিলে সেই অর্থের হানি হয় ৷
অর্জুন শ্রীকৃষ্ণ-সখা ৷ যাঁহারা শ্রীকৃষ্ণের সমসাময়িক, এক কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ, তাঁহারা মানবদেহধারী পুরুষােত্তমের সহিত স্ব স্ব অধিকার ও পূৰ্ব্বকৰ্ম্মভেদানুসারে নানা সম্বন্ধ স্থাপন করিলেন ৷ উদ্ধব শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত, সাত্যকি তাহার অনুগত সহচর ও অনুচর, রাজা যুধিষ্ঠির তাঁহার মন্ত্রণাচালিত আত্মীয় ও বন্ধু, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের সহিত অর্জুনের ন্যায় কেহই ঘনিষ্ঠতা স্থাপন করিতে পারেন নাই ৷ সমবয়স্ক পুরুষে পুরুষে যত মধুর ও নিকট সম্বন্ধ হইতে পারে, শ্রীকৃষ্ণে অর্জুনে সেই সকল মধুর সম্বন্ধ বিদ্যমান ছিল ৷ অৰ্জ্জুন শ্রীকৃষ্ণের ভাই, তাহার প্রিয়তম সখা, তাহার প্রাণপ্রতিম ভগিনী সুভদ্রার স্বামী ৷ চতুর্থ অধ্যায়ে ভগবান এই ঘনিষ্ঠতা অর্জুনকেগীতার পরম রহস্য শ্রবণের পাত্ররূপে বরণ করিবার কারণ বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন ৷
স এবায়ং ময়া তেইদ্য যােগঃ প্রােক্তঃ পুরাতনঃ ৷ ভক্তোহসি মে সখা চেতি রহস্যং হ্যেতদুত্তমম্ ॥
“এই পুরাতন লুপ্ত যােগ আমি আজ আমার ভক্ত ও সখা বলিয়া তােমার নিকট প্রকাশ করিলাম ৷ কারণ, এই যােগ জগতের শ্রেষ্ঠ ও পরম রহস্য ৷” অষ্টাদশ অধ্যায়েও গীতার কেন্দ্রস্বরূপ কর্মযােগের মূলমন্ত্র ব্যক্ত করিবার সময় এই কথার পুনরুক্তি হইয়াছে ৷
সৰ্ব্বগুহ্যতমং ভূয়ঃ শৃণু মে পরমং বচঃ ৷ ইষ্টোহসি মে দৃঢ়মিতি ততাে বক্ষ্যামি তে হিত ॥
“আবার আমার পরম ও সর্বাপেক্ষা গুহ্যতম কথা শ্রবণ কর ৷ তুমি আমার অতীব প্রিয়, সেই হেতু তােমার নিকট এই শ্রেয়ঃ পথের কথা প্রকাশ করিব ৷” এই শ্লোকদ্বয়ের তাৎপৰ্য্য শ্রুতির অনুকূল, যেমন কঠোপনিষদে বলা হইয়াছে,
নায়মাত্মা প্রবচনেন লভ্যো ন মেধয়া ন বহুনা শুতেন ৷ যমেবৈষ বৃণুতে তেন লভ্যস্তস্যৈষ আত্মা বিবৃণুতে তনুং স্বা ॥
“এই পরমাত্মা দার্শনিকের ব্যাখ্যা দ্বারাও লভ্য নহে, মেধাশক্তি দ্বারাও লভ্য নহে, বিস্তর শাস্ত্রজ্ঞান দ্বারাও লভ্য নহে ৷ ভগবান যাঁহাকে বরণ করেন, তাহারই লভ্য; তাহারই নিকট এই পরমাত্মা স্বীয় শরীর প্রকাশ করেন ৷” অতএব যিনি ভগবানের সহিত সখ্য ইত্যাদি মধুর সম্বন্ধ স্থাপন করিতে সমর্থ, তিনিই গীতােক্ত জ্ঞানের পাত্র ৷
ইহার মধ্যে আর এক অতি প্রয়ােজনীয় কথা নিহিত ৷ ভগবান অর্জুনকে এক শরীরে ভক্ত ও সখা বলিয়া বরণ করিলেন ৷ ভক্ত নানাবিধ; সাধারণতঃ কাহাকেও ভক্ত বলিলে গুরুশিষ্য সম্বন্ধের কথা মনে উঠে ৷ সেই ভক্তির মূলে প্রেম আছে বটে, কিন্তু সাধারণতঃ বাধ্যতা, সম্মান ও অন্ধভক্তি তাহার বিশেষ লক্ষণ ৷ সখা কিন্তু সখাকে সম্মান করেন না; তাহার সহিত ক্রীড়াকৌতুক আমােদ ও স্নেহ-সম্ভাষণ করেন; ক্রীড়ার্থ তাহাকে উপহাস ও তাচ্ছিল্যও করেন, গালি দেন, তাহার উপর দৌরাত্ম্য করেন ৷ সখা সৰ্ব্বকালে সখার বাধ্য হয়েন না, তাঁহার জ্ঞানগরিমা ও অকপট হিতৈষিতায় মুগ্ধ হইয়া যদিও তাহার উপদেশানুসারে চলেন, সে অন্ধভাবে নহে; তাহার সহিত তর্ক করেন, সন্দেহ সকল জ্ঞাপন করেন, মধ্যে মধ্যে তাহার মতের প্রতিবাদও করেন ৷ ভয়বিসর্জন সখ্য সম্বন্ধের প্রথম শিক্ষা; সম্মানের বাহ্য আড়ম্বর বিসর্জন তাহার দ্বিতীয় শিক্ষা; প্রেম তাহার প্রথম কথা ও শেষ কথা ৷ যিনি এই জগৎসংসারকে মাধুৰ্য্যময়, রহস্যময়, প্রেমময়, আনন্দময় ক্রীড়া বুঝিয়া ভগবানকে ক্রীড়ার সহচররূপে বরণ করিয়া সখ্য সম্বন্ধে আবদ্ধ করিতে পারেন, তিনি গীতােক্ত জ্ঞানের পাত্র ৷ যিনি ভগবানের মহিমা, প্রভুত্ব, জ্ঞানগরিমা, ভীষণত্বও হৃদয়ঙ্গম করেন, অথচ অভিভূত না হইয়া তাহার সহিত নির্ভয়ে ও হাসিমুখে খেলা করিয়া থাকেন, তিনি গীতােক্ত জ্ঞানের পাত্র ৷
সখ্য সম্বন্ধের মধ্যে ক্রীড়াচ্ছলে আর সকল সম্বন্ধ অন্তর্ভুক্ত হইতে পারে গুরুশিষ্য সম্বন্ধ সখ্যে প্রতিষ্ঠিত হইলে অতি মধুর হয়, এইরূপ সম্বন্ধই অর্জুন গীতার প্রারম্ভে শ্রীকৃষ্ণের সহিত স্থাপন করিলেন ৷ “তুমি আমার পরম হিতৈষী বন্ধু, তােমা ভিন্ন কাহার শরণাপন্ন হইব? আমি হতবুদ্ধি, কর্তব্যভারে ভীত, কর্তব্য সম্বন্ধে সন্দিগ্ধ, তীব্র শােকে অভিভূত ৷ তুমি আমাকে রক্ষা কর, উপদেশ দান কর, আমার ঐহিক পারত্রিক মঙ্গলের সমস্ত ভার তােমার উপর ন্যস্ত করিলাম ৷” এই ভাবে অর্জুন মানবজাতির সখা ও সহায়ের নিকট জ্ঞানলাভার্থ আসিয়াছিলেন ৷ আবার মাতৃসম্বন্ধ এবং বাৎসল্যভাবও সখ্যে সন্নিবিষ্ট হয় ৷ বয়ােজ্যেষ্ঠ ও জ্ঞানশ্রেষ্ঠ, কনীয়ান ও অল্পবিদ্য সখাকে মাতৃবৎ ভালবাসেন ও রক্ষা করেন, যত্ন করেন, সর্বদা কোলে রাখিয়া বিপদ ও অশুভ হইতে পরিত্রাণ করেন ৷ যিনি শ্রীকৃষ্ণের সহিত সখ্য স্থাপন করেন, শ্রীকৃষ্ণ তাহার নিকট স্বীয় মাতৃরূপও প্রকাশ করেন ৷ সখ্যের মধ্যে যেমন মাতৃপ্রেমের গভীরতা, তেমনই দাম্পত্যপ্রেমের তীব্রতা ও উৎকট আনন্দও আসিতে পারে ৷ সখা সখার সান্নিধ্য সর্বদা প্রার্থনা করেন, তাঁহার বিরহে কাতর হয়েন; তাঁহার দেহস্পর্শে পুলকিত হয়েন, তাহার জন্য প্রাণ পৰ্য্যন্ত ত্যাগ করিতে আনন্দভােগ করেন ৷ দাস্য সম্বন্ধও সখ্যের ক্রীড়ার অন্তর্ভুক্ত হইলে অতি মধুর হয় ৷ বলা হইয়াছে, যিনি যত মধুর সম্বন্ধ পুরুষােত্তমের সহিত স্থাপন করিতে পারেন, তাহার সখ্যভাব তত প্রস্ফুটিত হয় এবং তত গীতােক্ত জ্ঞানের পাত্রত্ব লাভ হয় ৷
কৃষ্ণসখা অৰ্জ্জুন মহাভারতের প্রধান কর্মী, গীতায় কর্মযােগশিক্ষা প্রধান শিক্ষা ৷ জ্ঞান, ভক্তি, কৰ্ম্ম এই তিন মার্গ পরস্পর বিরােধী নহে, কৰ্ম্মমার্গে জ্ঞান-প্রবর্তিত কৰ্ম্মে ভক্তিলব্ধ শক্তি প্রয়ােগ করিয়া ভগবদুদ্দেশ্যে তাঁহারই সহিত যুক্ত হইয়া তাহারই আদিষ্ট কৰ্ম্ম করা গীতােক্ত শিক্ষা ৷ যাঁহারা সংসারের দুঃখে ভীত, বৈরাগ্যপীড়িত, ভগবানের লীলায় জাতবিতৃষ্ণ, লীলা পরিত্যাগ করিয়া অনন্তের ক্রোড়ে লুক্কাইয়া থাকিতে ইচ্ছুক, তাহাদের মার্গ স্বতন্ত্র ৷ বীরশ্রেষ্ঠ মহাধনুর্ধর অর্জুনের সেইরূপ কোনও ইচ্ছা বা ভাব ছিল না ৷ শ্রীকৃষ্ণ কোন শান্ত সন্ন্যাসী বা দার্শনিক জ্ঞানীর নিকট এই উত্তম রহস্য প্রকাশ করেন নাই, কোন অহিংসা-পরায়ণ ব্রাহ্মণকে এই শিক্ষার পাত্র বলিয়া বরণ করেন নাই, মহাপরাক্রমী তেজস্বী ক্ষত্রিয় যােদ্ধা এই অতুলনীয় জ্ঞানলাভের উপযুক্ত আধার বলিয়া নির্ণীত হইয়াছিলেন ৷ যিনি সংসারযুদ্ধে জয় বা পরাজয়ে অবিচলিত, তিনিই এই শিক্ষার গৃঢ়তম স্তরে প্রবেশ করিতে সমর্থ ৷ নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ ৷ যিনি মুমুক্ষুত্ব ৷ অপেক্ষা ভগবান-লাভের আকাঙ্ক্ষা পােষণ করেন তিনিই ভগবৎ-সান্নিধ্যের আস্বাদ পাইয়া আপনাকে নিত্যমুক্ত-স্বভাববান বলিয়া উপলব্ধি করিতে এবং মুমুক্ষুত্ব অজ্ঞানের শেষ আশ্রয় বুঝিয়া বর্জন করিতে সক্ষম ৷ যিনি তামসিক ও রাজসিক অহঙ্কার বর্জন করিয়া সাত্ত্বিক অহঙ্কারে বদ্ধ থাকিতে চাহেন না, তিনিই গুণাতীত হইতে সক্ষম ৷ অর্জুন ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্ম পালনে রাজসিক বৃত্তি চরিতার্থ করিয়াছেন, অথচ সাত্ত্বিক আদর্শ গ্রহণে রজঃশক্তিকে সত্বমুখী করিয়াছেন ৷ সেইরূপ পাত্র গীতােক্ত শিক্ষার উত্তম আধার ৷
অৰ্জ্জুন সমসাময়িক মহাপুরুষদিগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন না ৷ আধ্যাত্মিক জ্ঞানে ব্যাসদেব শ্রেষ্ঠ, সেই যুগের সর্ববিধ সাংসারিক জ্ঞানে পিতামহ ভীষ্ম শ্রেষ্ঠ, জ্ঞানতৃষ্ণায় রাজা ধৃতরাষ্ট্র ও বিদুর শ্রেষ্ঠ, সাধুতায় ও সাত্ত্বিক গুণে ধৰ্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির শ্রেষ্ঠ, ভক্তিতে উদ্ধব ও অক্র শ্রেষ্ঠ, স্বভাবগত শৌর্য্যে ও পরাক্রমে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মহারথী কর্ণ শ্রেষ্ঠ ৷ অথচ অর্জুনকেই জগৎপ্রভু বরণ করিয়াছিলেন, তাহারই হস্তে অচলা জয়শ্রী এবং গাণ্ডীব প্রভৃতি দিব্য অস্ত্র সমর্পণ করিয়া তাহার দ্বারা ভারতের সহস্র সহস্ৰ জগদ্বিখ্যাত যােদ্ধাকে নিপাত করিয়া যুধিষ্ঠিরের অসপত্ন সাম্রাজ্য অৰ্জ্জুনের পরাক্রমলব্ধ দানরূপে সংস্থাপন করিলেন; উপরন্তু তাহাকেই গীতােক্ত পরম জ্ঞানের একমাত্র উপযুক্ত পাত্র বলিয়া নির্ণীত করিলেন ৷ অৰ্জ্জুনই মহাভারতের নায়ক ও প্রধান কর্মী, সেই কাব্যের প্রত্যেক অংশ তঁাহারই যশােকীৰ্ত্তি ঘােষণা করে ৷ ইহা পুরুষােত্তম বা মহাভারত-রচয়িতা ব্যাসদেবের অন্যায় পক্ষপাত নহে ৷ এই উৎকর্ষ সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা ও আত্মসমর্পণের ফল ৷ যিনি পুরুষােত্তমের উপর সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা ও নির্ভরপূর্বক কোনও দাবী না করিয়া স্বীয় শুভ ও অশুভ, মঙ্গল ও অমঙ্গল, পাপ ও পুণ্যের সমস্ত ভার তাহাকে সমর্পণ করেন, নিজ প্রিয়কৰ্ম্মে আসক্ত না হইয়া তদাদিষ্ট কৰ্ম্ম করিতে ইচ্ছুক হয়েন, নিজ প্রিয়বৃত্তি চরিতার্থ না করিয়া তৎপ্রেরিত বৃত্তি গ্রহণ করেন, নিজ প্রশংসিত গুণ সাগ্রহে আলিঙ্গন না করিয়া তদ্দত্ত গুণ ও প্রেরণা তাহারই কাৰ্যে প্রযুক্ত করেন; সেই শ্রদ্ধাবান অহঙ্কাররহিত কৰ্ম্মযােগী পুরুষােত্তমের প্রিয়তম সখা ও শক্তির উত্তম আধার, তাহা দ্বারা জগতের বিরাট কাৰ্য্য নির্দোষরূপে সম্পন্ন হয় ৷ ইসলাম-প্রণেতা মুহম্মদ এইরূপ যােগীশ্রেষ্ঠ ছিলেন ৷ অর্জুনও সেইরূপ আত্মসমর্পণ করিতে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন; সেই চেষ্টা শ্রীকৃষ্ণের প্রসন্নতা ও ভালবাসার কারণ ৷ যিনি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের দৃঢ়চেষ্টা করেন, তিনিই গীতােক্ত শিক্ষার উত্তম অধিকারী ৷ শ্রীকৃষ্ণ তাহার গুরু ও সখা হইয়া তাহার ইহলােকের ও পরলােকের সমস্ত ভার গ্রহণ করেন ৷
অবস্থা
মনুষ্যের প্রত্যেক কাৰ্য্য ও উক্তির উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পূর্ণরূপে বুঝিতে হইলে কি অবস্থায় সেই কাৰ্য্য বা সেই উক্তি কৃত বা ব্যক্ত হইয়াছে, তাহা জানা আবশ্যক ৷ কুরুক্ষেত্র মহাযুদ্ধের প্রারম্ভকালে যখন শস্ত্রপ্রয়ােগ আরম্ভ হইয়াছে ৷ – প্রবৃত্তে শস্ত্রসম্পাতে – সেই সময়ে ভগবান গীতা প্রকাশ করিয়াছেন ৷ ইহাতে অনেকে বিস্মিত ও বিরক্ত হন, বলেন ইহা নিশ্চয় কবির অসাবধানতা বা বুদ্ধির দোষ ৷ প্রকৃতপক্ষে সেই সময়ে সেই স্থানে সেইরূপ ভাবাপন্ন পাত্রকে দেশকালপাত্র বুঝিয়া শ্রীকৃষ্ণ গীতােক্ত জ্ঞান প্রকাশ করিয়াছেন ৷
সময় যুদ্ধের প্রারম্ভকাল ৷ যাঁহারা প্রবল কৰ্ম্মস্রোতে নিজ বীরত্ব ও শক্তি বিকাশ ও পরীক্ষা করেন নাই, তাহারা কখনও গীতােক্ত জ্ঞানের অধিকারী হইতে পারেন না ৷ উপরন্তু যাঁহারা কোন কঠিন মহাব্রত আরম্ভ করিয়াছেন, যে মহাব্রতে অনেক বাধাবিঘ্ন, অনেক শক্রবৃদ্ধি, অনেক পরাজয়ের আশঙ্কা স্বভাবতঃই হয়, সেই মহাব্রতের আচরণে যখন দিব্যশক্তি জন্মিয়াছে, তখন ব্রতের শেষ উদ্যাপনার্থে, ভগবানের কার্যসিদ্ধ্যর্থ এই জ্ঞান প্রকাশ হয় ৷ গীতা কৰ্ম্মযােগকে ভগবানলাভের প্রতিষ্ঠা বিহিত করে, শ্রদ্ধা ও ভক্তিপূর্ণ কৰ্ম্মেতেই জ্ঞান জন্মায়, অতএব গীতােক্ত মার্গের পথিক পথত্যাগ করিয়া দূরস্থ শান্তিময় আশ্রমে পৰ্বতে বা নির্জন স্থানে ভগবানের সাক্ষাৎলাভ করেন না, মধ্যপথেই কৰ্ম্মের কোলাহলের মধ্যে হঠাৎ সেই স্বর্গীয় দীপ্তি জগৎ আলােকিত করে, সেই মধুর তেজোময়ী বাণী কর্ণকুহরে প্রবেশ করে ৷
স্থান যুদ্ধক্ষেত্র, সৈন্যদ্বয়ের মধ্যস্থল, সেখানে শস্ত্রপাত হইতেছে ৷ যাঁহারা এই পথে পথিক, এইরূপ কৰ্ম্মে অগ্রণী, প্রায়ই কোনও গুরুতর ফলােৎপাদক সময়ে, যখন কর্মীর কৰ্ম্মানুসারে অদৃষ্টের গতি এদিক না ওদিক চালিত হইবে, তখনই অকস্মাৎ তাঁহাদের যােগসিদ্ধি ও পরমজ্ঞানলাভ হয় ৷ তঁাহার জ্ঞান কৰ্ম্মরােধক ৷ নয়, কৰ্ম্মের সহিত সংশ্লিষ্ট ৷ ইহাও সত্য যে ধ্যানে, নির্জনে, স্বস্থ আত্মার মধ্যে জ্ঞানােন্মীলন হয়, সেইজন্য মনীষিগণ নির্জনে থাকিতে ভালবাসেন ৷ কিন্তু গীতােক্ত যােগের পথিক মন-প্রাণ-দেহরূপ আধার এমনভাবে বিভক্ত করিতে পারেন যে, তিনি জনতায় নির্জনতা, কোলাহলে শান্তি, ঘাের কর্মপ্রবৃত্তিতে পরম নিবৃত্তি অনুভব করেন ৷ তিনি অন্তরকে বাহ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করেন না, বরং বাহ্যকে ৷ অন্তর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করেন ৷ সাধারণ যােগী সংসারকে ভয় করেন, পলায়নপূর্বক যােগাশ্রমে শরণ লইয়া যােগে প্রবৃত্ত হন ৷ সংসারই কর্মযােগীর যােগাশ্রম ৷ সাধারণ যােগী বাহ্যিক শান্তি ও নীরবতা অভিলাষ করেন, শান্তিভঙ্গে তাহার তপােভঙ্গ হয় ৷ কর্মযােগী অন্তরে বিশাল শান্তি ও নীরবতা ভােগ করেন, বাহ্যিক কোলাহলে সেই অবস্থা আরও গভীর হয়, বাহ্যিক তপােভঙ্গে সেই স্থির আন্তরিক তপঃ ভগ্ন হয় না, অবিচলিত থাকে ৷ লােকে বলে, সমরােদ্যত সৈন্যের মধ্যভাগে শ্রীকৃষ্ণ-অর্জুন সংবাদ কিরূপে সম্ভব হয়? উত্তর, যােগপ্রভাবে সম্ভব হয় ৷ সেই যােগবলে যুদ্ধের কোলাহলের মধ্যে একস্থানে শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের অন্তরে ও বাহিরে শান্তি বিরাজ করে, যুদ্ধের কোলাহল সেই দুইজনকে স্পর্শ করিতে পারে নাই ৷ ইহাতে কর্মোপযােগী আর এক আধ্যাত্মিক শিক্ষা নিহিত ৷ যাঁহারা গীতােক্ত যােগ অনুশীলন করেন, তাহারা শ্রেষ্ঠ কৰ্ম্মী অথচ কৰ্ম্মে অনাসক্ত ৷ কর্মের মধ্যেই আত্মার আন্তরিক আহ্বান শ্রবণে তাহারা কর্মে বিরত হইয়া যােগমগ্ন ও তপস্যারত হন ৷ তাহারা জানেন কৰ্ম্ম ভগবানের, ফল ভগবানের, আমরা যন্ত্র, অতএব কৰ্ম্মফলের জন্য উৎকণ্ঠিত হন না ৷ ইহাও জানেন যে, কর্মযােগের সুবিধার জন্য, কর্মের উন্নতির জন্য, জ্ঞানবৃদ্ধি ও শক্তিবৃদ্ধির জন্য সেই আহ্বান হয় ৷ অতএব কর্মে বিরত হইতে ভয় করেন না, জানেন যে তপস্যায় কখনও বৃথা সময়ক্ষেপ হইতে পারে না ৷
পাত্রের ভাব, কর্মযােগীর শেষ সন্দেহের উদ্রেক ৷ বিশ্বসমস্যা, সুখদুঃখ সমস্যা, পাপপুণ্য সমস্যায় বিব্রত হইয়া অনেকে পলায়নই শ্রেয়স্কর বলিয়া নিবৃত্তি, বৈরাগ্য ও কৰ্ম্মত্যাগের প্রশংসা ঘােষণা করেন ৷ বুদ্ধদেব জগৎ অনিত্য ও দুঃখময় বুঝাইয়া নিৰ্বাণপ্রাপ্তির পথ দেখাইয়াছেন ৷ যীশু, টলষ্টয় ইত্যাদি মানবজাতির সন্ততিস্থাপক বিবাহপদ্ধতি ও জগতের চিরন্তন নিয়ম যুদ্ধের ঘাের বিরােধী ৷ সন্ন্যাসী বলেন, কৰ্ম্মই অজ্ঞানসৃষ্ট, অজ্ঞান বর্জন কর, কৰ্ম্ম বর্জন কর, শান্ত নিস্ক্রিয় হও ৷ অদ্বৈতবাদী বলেন, জগৎ মিথ্যা, জগৎ মিথ্যা, ব্রহ্মে বিলীন হও ৷ তবে এই জগৎ কেন, এই সংসার কেন? ভগবান যদি থাকেন, কেন অৰ্ব্বাচীন বালকের ন্যায় এই বৃথা পণ্ডশ্রম, এই নীরস উপহাস আরম্ভ করিয়াছেন? আত্মাই যদি থাকেন, জগৎ মায়াই হয়, এই আত্মাই বা কেন এই জঘন্য স্বপ্ন নিজ নিৰ্ম্মল অস্তিত্বে অধ্যারােপ করিয়াছেন? নাস্তিক বলেন, ভগবানও নাই, আত্মাও নাই, আছে অন্ধশক্তির অন্ধ ক্রিয়া মাত্র ৷ তাহাই বা কিরূপ কথা? শক্তি কাহার? কোথা হইতে সৃষ্ট হইল, কেনই বা অন্ধ ও উন্মত্ত? এই সকল প্রশ্নের সন্তোষজনক ৷ মীমাংসা কেহই করিতে পারেন নাই, না খৃষ্টান, না বৌদ্ধ, না অদ্বৈতবাদী, না নাস্তিক, না বৈজ্ঞানিক; সকলেই এই বিষয়ে নিরুত্তর অথচ সমস্যা এড়াইয়া ফাকি দিতে সচেষ্ট ৷ এক উপনিষদ ও তাহার অনুকূল গীতা এইরূপ ফঁাকি দিতে অনিচ্ছুক ৷ সেইজন্য কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে গীতা গীত হইয়াছে ৷ ঘাের সাংসারিক কর্ম্ম, গুরুহাত্যা, ভ্রাত্রুহত্যা, আত্মীয়্হ্ত্যা তাহার উদ্দেশ্য, সেই অযুত প্রাণীসংহারক ৷ যুদ্ধের প্রারম্ভে, অর্জুন হতবুদ্ধি হইয়া গাণ্ডীব হস্ত হইতে নিক্ষেপ করিয়াছেন, কাতরস্বরে বলিতেছেন –
তৎ কিং কৰ্ম্মণি ঘােরে মাং নিয়ােজয়সি কেশব ৷
“কেন আমাকে এই ঘাের কর্মে নিযুক্ত করিতেছ?” উত্তরে সেই যুদ্ধের কোলাহলের মধ্যে বজ্রগম্ভীর স্বরে ভগবৎ-মুখনিঃসৃত মহাগীতি উঠিয়াছে ৷ –
কুরু কৰ্ম্মৈব তস্মাৎ ত্বং পূৰ্ব্বৈঃ পূৰ্ব্বতরং কৃতম্ ৷ যােগস্থঃ কুরু কৰ্ম্মাণি সঙ্গং ত্যক্কা ধনঞ্জয় ৷ বুদ্ধিযুক্তো জহাতীহ উভে সুকৃতদুষ্কৃতে ৷ তস্মাদ যােগায় যুজ্যস্ব যােগঃ কৰ্ম্মসু কৌশল ॥ অসক্তো হ্যাচরন্ কৰ্ম্ম পরমাপ্নোতি পূরুষঃ ॥ ময়ি সৰ্বাণি কৰ্ম্মাণি সংন্যস্যাধ্যাত্মচেতসা ৷ নিরাশীনিৰ্ম্মমাে ভূত্বা যুধ্যস্ব বিগতজ্বরঃ ॥ গতসঙ্গস্য মুক্তস্য জ্ঞানাবস্থিতচেতসঃ ৷ যজ্ঞায়াচরতঃ কৰ্ম্ম সমগ্রং প্রবিলীয়তে ॥ অজ্ঞানেনাবৃতং জ্ঞানং তেন মুহ্যন্তি জন্তবঃ ॥ ভােক্তারং যজ্ঞতপসাং সর্বলােকমহেশ্বর ৷ সুহৃদং সৰ্ব্বভূতানাং জ্ঞাত্বা মাং শান্তিচ্ছতি ॥ ময়া হতাংস্কৃং জহি মা ব্যথিষ্ঠা ৷ যুধ্যস্ব জেতাসি রণে সপত্নান ॥ যস্য নাহংকৃতাে ভাবাে বুদ্ধিস্য ন লিপ্যতে ৷ হত্বাপি স ইমাল্লোকান্ ন হন্তি ন নিবধ্যতে ॥
কুরু কৰ্ম্মৈব তস্মাৎ ত্বং পূৰ্ব্বৈঃ পূৰ্ব্বতরং কৃতম্ ৷
যােগস্থঃ কুরু কৰ্ম্মাণি সঙ্গং ত্যক্কা ধনঞ্জয় ৷
বুদ্ধিযুক্তো জহাতীহ উভে সুকৃতদুষ্কৃতে ৷ তস্মাদ যােগায় যুজ্যস্ব যােগঃ কৰ্ম্মসু কৌশল ॥
অসক্তো হ্যাচরন্ কৰ্ম্ম পরমাপ্নোতি পূরুষঃ ॥
ময়ি সৰ্বাণি কৰ্ম্মাণি সংন্যস্যাধ্যাত্মচেতসা ৷
নিরাশীনিৰ্ম্মমাে ভূত্বা যুধ্যস্ব বিগতজ্বরঃ ॥
গতসঙ্গস্য মুক্তস্য জ্ঞানাবস্থিতচেতসঃ ৷ যজ্ঞায়াচরতঃ কৰ্ম্ম সমগ্রং প্রবিলীয়তে ॥
অজ্ঞানেনাবৃতং জ্ঞানং তেন মুহ্যন্তি জন্তবঃ ॥
ভােক্তারং যজ্ঞতপসাং সর্বলােকমহেশ্বর ৷ সুহৃদং সৰ্ব্বভূতানাং জ্ঞাত্বা মাং শান্তিচ্ছতি ॥
ময়া হতাংস্কৃং জহি মা ব্যথিষ্ঠা ৷ যুধ্যস্ব জেতাসি রণে সপত্নান ॥
যস্য নাহংকৃতাে ভাবাে বুদ্ধিস্য ন লিপ্যতে ৷ হত্বাপি স ইমাল্লোকান্ ন হন্তি ন নিবধ্যতে ॥
“অতএব তুমি কৰ্ম্মই করিয়া থাক, তােমার পূর্বপুরুষগণ পূর্বে যে কৰ্ম্ম করিয়া আসিতেছেন, তােমাকেও সেই কৰ্ম্ম করিতে হইবে ৷ ...যােগস্থ অবস্থায় আসক্তি পরিত্যাগপূৰ্ব্বক কৰ্ম্ম কর ৷ ...যাঁহার বুদ্ধি যােগস্থ, তিনি পাপ পুণ্য এই কর্মক্ষেত্রেই অতিক্রম করেন, অতএব যােগার্থ সাধনা কর, যােগই শ্রেষ্ঠ কৰ্ম্মসাধন ৷ ...মানুষ যদি অনাসক্তভাবে কৰ্ম্ম করেন, তিনি নিশ্চয় পরম ভগবানকে লাভ করিবেন ৷ ...জ্ঞানপূর্ণ হৃদয়ে আমার উপর তােমার সকল কর্ম নিক্ষেপ কর, কামনা পরিত্যাগে, অহঙ্কার পরিত্যাগে দুঃখরহিত হইয়া যুদ্ধে লাগ ৷ ...যিনি মুক্ত, আসক্তিরহিত, যাঁহার চিত্ত সৰ্ব্বদা জ্ঞানে নিবাস করে, যিনি যজ্ঞার্থে কৰ্ম্ম করেন, তঁাহার সকল কর্ম বন্ধনের কারণ না হইয়া তখনই আমার মধ্যে সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয় ৷ ..সর্বপ্রাণীর অন্তর্নিহিত জ্ঞান অজ্ঞান দ্বারা আবৃত, সেই হেত তাহারা ৷ সুখ দুঃখ, পাপ পুণ্য ইত্যাদি দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করিয়া মােহে পতিত হয় ৷ ...আমাকে সর্বলােকের মহেশ্বর, যজ্ঞ, তপস্যা প্রভৃতি সৰ্ববিধ কর্মের ভােক্তা এবং সৰ্ব্বভূতের সখা ও বন্ধু বলিয়া জানিলে পরম শান্তিলাভ হয় ৷ ...আমিই তােমার শত্রুগণকে বধ করিয়াছি, তুমি যন্ত্র হইয়া তাহাদের সংহার কর, দুঃখিত হইও না, যুদ্ধে লাগিয়া যাও, বিপক্ষকে রণে জয় করিবে ৷ ...যাঁহার অন্তঃকরণ অহংজ্ঞানশূন্য, যাঁহার বুদ্ধি নির্লিপ্ত, তিনি যদি সমস্ত জগৎকে সংহার করেন, তথাপি তিনি হত্যা করেন নাই, তাহার পাপরূপ কোন বন্ধন হয় না ৷”
প্রশ্ন এড়াইবার, ফাকি দিবার কোন লক্ষণ নাই ৷ প্রশ্নটী পরিষ্কারভাবে উত্থাপন ৷ করা হইল ৷ ভগবান কি, জগৎ কি, সংসার কি, ধৰ্ম্মপথ কি, গীতায় এই সকল প্রশ্নের উত্তর সংক্ষেপে দেওয়া হইয়াছে ৷ অথচ সন্ন্যাসশিক্ষা নয়, কৰ্ম্মশিক্ষাই গীতার উদ্দেশ্য ৷ ইহাতেই গীতার সার্বজনীন উপযােগিতা ৷
প্রথম অধ্যায়
ধৃতরাষ্ট্র উবাচ
ধৰ্ম্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ ৷ মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব কিমকুব্বত সঞ্জয় ॥১॥
ধৃতরাষ্ট্র বলিলেন, —
হে সঞ্জয়, ধৰ্ম্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধার্থে সমবেত হইয়া আমার পক্ষ ও পাণ্ডবপক্ষ কি করিলেন ৷
সঞ্জয় উবাচ
দৃষ্টা তু পাণ্ডবানীকং ন্যূঢ়ং দুর্যোধনস্তদা ৷ আচাৰ্য্যমুপসঙ্গম্য রাজা বচনমব্রবীৎ ॥২॥
সঞ্জয় বলিলেন, –
তখন রাজা দুর্যোধন রচিতব্যুহ পাণ্ডব-অনীকিনী দেখিয়া আচার্যের নিকট উপস্থিত হইয়া এই কথা বলিলেন ৷
পশ্যৈতাং পাণ্ডুপুত্ৰাণামাচাৰ্য মহতীং চমূম্ ৷ বঢ়াং দ্রুপদপুত্রেণ তব শিষ্যেণ ধীমতা ॥৩॥
“দেখুন, আচাৰ্য্য, আপনার মেধাবী শিষ্য দ্রুপদতনয় ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্বারা রচিতব্যুহ এই মহতী পাণ্ডবসেনা দেখুন ৷”
অত্র শূরা মহেষাসা ভীমার্জুনসমা যুধি ৷ যধানাে বিরাটশ্চ দ্রুপদশ্চ মহারথঃ ॥৪॥ ধৃষ্টকেতুশ্চেকিতানঃ কাশিরাজশ্চ বীৰ্য্যবা ৷ পুরুজিৎ কুন্তিভােজশ্চ শৈব্যশ্চ নরপুঙ্গবঃ ॥৫॥ যুধামন্যুশ্চ বিক্রান্ত উত্তমৌজাশ্চ বীৰ্য্যবান ৷ সৌভদ্রো দ্রৌপদেয়াশ্চ সৰ্ব্ব এব মহারথাঃ ॥৬॥
এই বিরাট সৈন্যে ভীম ও অর্জুনের সমান মহাধনুৰ্ধর বীরপুরুষ আছেন, – যুযুধান, বিরাট ও মহারথী দ্রুপদ,
ধৃষ্টকেতু, চেকিতান ও মহাপ্রতাপী কাশিরাজ, পুরুজিৎ, কুন্তিভােজ ও নরপুঙ্গব শৈব্য,
বিক্রমশালী যুধামন্যু ও প্রতাপবান উত্তমৌজা, সুভদ্রায় অভিমন্যু ও দ্রৌপদীর পুত্রগণ, সকলেই মহাযােদ্ধা ৷
অস্মাকং তু বিশিষ্টা যে তান্নিবােধ দ্বিজোত্তম ৷ নায়কা মম সৈন্যস্য সংজ্ঞার্থং তান্ ব্রবীমি তে ॥৭॥
আমাদের মধ্যে যাঁহারা অসাধারণ শক্তিসম্পন্ন, যাঁহারা আমার সৈন্যের নেতা, তাহাদের নাম আপনার স্মরণার্থ বলিতেছি, লক্ষ্য করুন ৷
ভবান ভীষ্মশ্চ কর্ণশ্চ কৃপশ্চ সমিতিঞ্জয়ঃ ৷ অশ্বত্থামা বিকর্ণশ্চ সৌমদত্তির্জয়দ্রথঃ ॥৮॥ অন্যে চ বহবঃ শূরা মদর্থে ত্যক্তজীবিতাঃ ৷ নানাশস্ত্রপ্রহরণাঃ সৰ্ব্বে যুদ্ধবিশারদাঃ ॥৯॥
আপনি, ভীষ্ম, কর্ণ ও সমরবিজয়ী কৃপ, অশ্বত্থামা, বিকর্ণ, সােমদত্ততনয় ভূরিশ্রবা এবং জয়দ্ৰথ,
এবং অন্য অনেক বীরপুরুষ আমার জন্য প্রাণের মমতা ত্যাগ করিয়াছেন, ইহারা সকলেই যুদ্ধবিশারদ ও নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ৷
অপৰ্য্যাপ্তং তদস্মাকং বলং ভীষ্মভিরক্ষিতম ৷ পৰ্য্যাপ্তং ত্বিদমেতেষাং বলং ভীমাভিরক্ষিতম্ ॥১০॥
আমাদের এই সৈন্যবল একে অপরিমিত, তাহাতে ভীষ্ম আমাদের রক্ষাকর্তা, তাহাদের ওই সৈন্যবল পরিমিত, ভীমই তাঁহাদের রক্ষা পাইবার আশাস্থল ৷
অয়নেষু চ সর্বেষু যথাভাগমবস্থিতাঃ ৷ ভীষ্মমেবাভিরক্ষন্তু ভবন্তঃ সৰ্ব্ব এব হি ॥১১॥
অতএব আপনারা যুদ্ধের যত প্রবেশস্থলে স্ব স্ব নির্দিষ্ট সৈন্যভাগে অবস্থান ৷ করিয়া সকলে ভীষ্মকেই রক্ষা করুন ৷”
তস্য সংজনয়ন্ হর্ষং কুরুবৃদ্ধঃ পিতামহঃ ৷ সিংহনাদং বিনদ্যোচ্চৈঃ শঙ্খং দধূমৌ প্রতাপবান্ ॥১২॥
দুর্যোধনের প্রাণে হর্ষোদ্রেক করিয়া কুরুবৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্ম উচ্চ সিংহনাদে রণস্থল ধ্বনিত করিয়া মহাপ্রতাপভরে শঙ্খনিনাদ করিলেন ৷
ততঃ শাশ্চ ভেৰ্য্যশ্চ পণবানকগােমুখাঃ ৷ সহসৈবাভ্যহন্যন্ত স শব্দস্তুমুলােহভবৎ ॥১৩॥
তখন শঙ্খ, ভেরী, পণব, পটহ ও গােমুখ বাদ্য অকস্মাৎ বাদিত হইল, রণস্থল উচ্চ-শব্দসঙ্কুল হইল ৷
ততঃ শ্বেতৈয়ৈযুক্তে মহতি স্যন্দনে স্থিতৌ ৷ মাধবঃ পাণ্ডবশ্চৈব দিব্যৌ শঙ্খেী প্রদধমতুঃ ॥১৪॥
অনন্তর শ্বেতাশ্বযুক্ত বিশাল রথে দণ্ডায়মান মাধব ও পাণ্ডুপুত্র অর্জুন দিব্য শঙ্খদ্বয় বাজাইলেন ৷
পাঞ্চজন্যং হৃষীকেশাে দেবদত্তং ধনঞ্জয়ঃ ৷ পৌণ্ডং দমৌ মহাশঙ্খং ভীমকৰ্ম্মা বৃকোদরঃ ॥১৫॥
হৃষীকেশ পাঞ্চজন্য, ধনঞ্জয় দেবদত্ত, ভীমকৰ্ম্মা বৃকোদর পৌণ্ড নামে মহাশঙ্খ বাজাইলেন ৷
অনন্তবিজয়ং রাজা কুন্তীপুত্রো যুধিষ্ঠিরঃ ৷ নকুলঃ সহদেবশ্চ সুঘােষমণিপুষ্পকৌ ॥১৬॥
কুন্তীপুত্র রাজা যুধিষ্ঠির অনন্তবিজয় শঙ্খ এবং নকুল সহদেব সুঘােষ ও মণিপুষ্পক শঙ্খ বাজাইলেন ৷
কাশ্যশ্চ পরমেশ্বাসঃ শিখণ্ডী চ মহারথঃ ৷ ধৃষ্টদ্যুম্নো বিরাটশ্চ সাত্যকিশ্চাপরাজিতঃ ॥১৭॥ দ্রুপদো দ্রৌপদেয়াশ্চ সৰ্ব্বশঃ পৃথিবীপতে ৷ সৌভদ্রশ্চ মহাবাহুঃ শঙ্খন্ দমুঃ পৃথক পৃথক্ ॥১৮॥
পরম ধনুর্দ্ধর কাশিরাজ, মহারথী শিখণ্ডী, ধৃষ্টদ্যুম্ন, অপরাজিত যােদ্ধা সাত্যকি, দ্রুপদ, দ্রৌপদীর পুত্রগণ, মহাবাহু সুভদ্রাতনয়, সকলেই চারিদিক হইতে স্ব স্ব শঙ্খ বাজাইলেন ৷
স ঘােষাে ধার্তরাষ্ট্রাণাং হৃদয়ানি ব্যদারয়ৎ ৷ নভশ্চ পৃথিবীঞ্চৈব তুমুলােহভ্যনুনাদয় ॥১৯॥
সেই মহাশব্দ আকাশ ও পৃথিবী তুমুলরবে প্রতিধ্বনিত করিয়া ধার্তরাষ্ট্রগণের হৃদয় বিদীর্ণ করিল ৷
অথ ব্যবস্থিতান্ দৃষ্টা ধাৰ্তরাষ্ট্রা কপিধ্বজঃ ৷ প্রবৃত্তে শস্ত্রসম্পাতে ধনুরুদ্যম্য পাণ্ডবঃ ॥২০॥ হৃষীকেশং তদা বাক্যমিদমাহ মহীপতে ৷
তখন শস্ত্রনিক্ষেপ আরব্ধ হইবার পরে পাণ্ডুপুত্র অর্জুন ধনু উত্তোলন করিয়া হৃষীকেশকে এই কথা বলিলেন ৷
অর্জুন উবাচ
সেনয়ােরুভয়াের্মধ্যে রথং স্থাপয় মেহচত ॥২১ ৷ যাবদেতান্নিরীক্ষেহহং যােঙ্কুকামানবস্থিতা ৷ কৈর্ময়া সহ যােদ্ধব্যমস্মিন্ রণসমুদ্যমে ॥২২॥ যােৎস্যমানানবেক্ষেহহং য এতেহত্র সমাগতাঃ ৷ ধার্তরাষ্ট্রস্য দুৰ্ব্বদ্ধেযুদ্ধে প্রিয়চিকীর্ষবঃ ॥২৩॥
অৰ্জ্জুন বলিলেন, –
“হে নিস্পাপ, দুই সৈন্যের মধ্যস্থলে আমার রথ স্থাপন কর, যতক্ষণ যুদ্ধস্পৃহায় অবস্থিত এই বিপক্ষগণকে নিরীক্ষণ করি ৷ জানিতে চাই, কাহাদের সহিত এই রণােৎসবে যুদ্ধ করিতে হইবে ৷
দেখি এই যুদ্ধপ্রার্থীগণ কাহারা, যাঁহারা যুদ্ধক্ষেত্রে দুর্বুদ্ধি ধৃতরাষ্ট্রতনয় দুর্যোধনের প্রিয়কাৰ্য্য করিবার কামনায় এইখানে সমাগত হইয়াছেন ৷”
এবমুক্তো হৃষীকেশাে গুড়াকেশেন ভারত ৷ সেনয়ােরুভয়াের্মধ্যে স্থাপয়িত্বা রথােত্তমম্ ॥২৪॥ ভীষ্মদ্রোণপ্রমুখতঃ সৰ্ব্বেষাঞ্চ মহীক্ষিতাম্ ৷ উবাচ পার্থ পশ্যৈতা সমবেতান্ কুরূনিতি ॥২৫॥
গুড়াকেশের এই কথা শুনিয়া হৃষীকেশ দুই সৈন্যের মধ্যস্থলে সেই উৎকৃষ্ট রথ স্থাপনপূর্বক
ভীষ্ম, দ্রোণ এবং সমুদায় নৃপতিবৃন্দের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া বলিলেন, “হে পার্থ, সমবেত কুরুগণকে দেখ ৷”
তাপশ্যৎ স্থিতান্ পার্থঃ পিতৃনথ পিতামহা ৷ আচাৰ্য্যান্ মাতুলান্ ভ্রাতৃ পুত্ৰান্ পৌত্রা সখীংস্তথা ৷ শ্বশুরান্ সুহৃদশ্চৈব সেনয়ােরুভয়ােরপি ॥২৬॥
সেই রণস্থলে পার্থ দেখিলেন পিতা, পিতামহ, আচার্য্য, মাতুল, ভ্রাতা, পুত্র, পৌত্র, সখা, শ্বশুর, সুহৃদ, যত আত্মীয় ও স্বজন, দুই পরস্পরবিরােধী সৈন্যে দণ্ডায়মান রহিয়াছেন ৷
তান্ সমীক্ষ্য স কৌন্তেয়ঃ সৰ্বান্ বন্ধুনবস্থিতান্ ৷ কৃপয়া পরয়াবিষ্টো বিষীদদিমব্রবীৎ ॥২৭॥
সেই সকল বন্ধুবান্ধবকে এইরূপ অবস্থিত দেখিয়া কুন্তীপুত্র তীব্র কৃপায় আবিষ্ট হইয়া বিষাদগ্রস্ত হৃদয়ে এই কথা বলিলেন ৷
দৃষ্ট্রেমান্ স্বজনা কৃষ্ণ যুযুৎসূন্ সমবস্থিতা ৷ সীদন্তি মম গাত্রাণি মুখঞ্চ পরিশুষ্যতি ॥২৮॥ বেপথুশ্চ শরীরে মে রােমহর্ষশ্চ জায়তে ৷ গাণ্ডীবং স্রংসতে হস্তাৎ ত্বক চৈব পরিদহ্যতে ॥২৯॥
“হে কৃষ্ণ, এই সকল স্বজনকে যদ্ধার্থে অবস্থিত দেখিয়া আমার দেহের অঙ্গ সকল অবসন্ন হইতেছে, মুখ শুকাইয়া যাইতেছে,
সমস্ত শরীরে কম্প ও রােমহর্ষ উপস্থিত, গাণ্ডীব অবশ হস্ত হইতে খসিয়া পড়িতেছে, চর্ম যেন অগ্নিতে দগ্ধ হইতেছে ৷
ন চ শক্লোম্যবস্থাতুং ভ্ৰমতীব চ মে মনঃ ৷ নিমিত্তানি চ পশ্যামি বিপরীতানি কেশব ॥৩০॥
আমি দাড়াইবার শক্তিরহিত হইলাম, মন যেন ঘুরিতে আরম্ভ করিয়াছে ৷ হে কেশব, অশুভ লক্ষণ সকল দেখিতেছি ৷
ন চ শ্ৰেয়ােহনুপশ্যামি হত্বা স্বজনমাহবে ৷ ন কাজে বিজয়ং কৃষ্ণ ন চ রাজ্যং সুখানি চ ॥৩১॥
যুদ্ধে স্বজন বধ করিয়া শ্রেয়ঃ দেখিতেছি না; হে কৃষ্ণ, আমি জয়ও চাহি না, রাজ্যও চাহি না, সুখও চাহি না ৷
কিং নাে রাজ্যেন গােবিন্দ কিং ভােগৈর্জীবিতেন বা ৷ যেষামর্থে কাঙিক্ষতং নাে রাজ্যং ভােগাঃ সুখানি চ ॥৩২॥ ত ইমেহবস্থিতা যুদ্ধে প্রাণাংস্ত্যক্তৃা ধনানি চ ৷ আচাৰ্য্যাঃ পিতরঃ পুত্ৰাস্তথৈব চ পিতামহাঃ ॥৩৩॥ মাতুলাঃ শ্বশুরাঃ পৌত্রাঃ শ্যালাঃ সম্বধিনস্তথা ৷ এতান্ন হনুমিচ্ছামি ঘুতােহপি মধুসূদন ॥৩৪॥
বল, গােবিন্দ, রাজ্যে আমাদের কি লাভ? কি লাভ ভােগে? কি প্রয়ােজন জীবনে? যাঁহাদের জন্য রাজ্য, ভােগ, জীবন বাঞ্ছনীয়,
তাঁহারাই জীবন ও ধন ত্যাগ করিয়া এই রণক্ষেত্রে উপস্থিত, – আচাৰ্য্য, পিতা, পুত্র, পিতামহ,
মাতুল, শ্বশুর, পৌত্র, শ্যালক, কুটুম্ব ৷ হে মধুসূদন, হঁহারা যদি আমাকে বধ করেন, তথাপি তাহাদিগকে বধ করিতে চাই না ৷
অপি ত্রৈলােক্যরাজ্যস্য হেতােঃ কিং নু মহীকৃতে ৷ নিহত্য ধার্তরাষ্ট্ৰান্নঃ কা প্রীতিঃ স্যাজ্জনার্দন ॥৩৫॥
ত্রিলােকরাজ্যের লােভেও চাই না, পৃথিবীর আধিপত্য ত দূরের কথা ৷ ধার্তরাষ্ট্রকে সংহার করিয়া, হে জনার্দন! আমাদের কি মনের সুখ হইতে পারে?
পাপমেবায়েদস্মন্ হত্বৈতানাততায়িনঃ ৷ তস্মান্নাহ বয়ং হং ধার্তরাষ্ট্ৰান্ সবান্ধবান্ ৷ স্বজনং হি কথং হত্বা সুখিনঃ স্যাম মাধব ॥৩৬॥
ইহারা আততায়ী, তথাপি ইহাদের বধ করিলে পাপই আমাদের মনে আশ্রয় পাইবে ৷ অতএব ধার্তরাষ্ট্রগণ যখন আমাদের আত্মীয়, তখন তাহাদিগকে সংহার করিতে আমরা অধিকারী নহি ৷ হে মাধব, স্বজন বধে আমরা কিরূপে সুখী হইব?
যদ্যপ্যেতে ন পশ্যন্তি লােভােপহতচেতসঃ ৷ কুলক্ষয়কৃতং দোষং মিত্রদ্রোহে চ পাতকম্ ॥৩৭॥ কথং ন জ্ঞেয়মপ্যাভিঃ পাপাদম্মানিবৰ্ত্তিতুম্ ৷ কুলক্ষয়কৃতং দোষং প্রপশ্যদ্ভিজ্জনার্দন ॥৩৮॥
যদিও ইহারা লােভে বুদ্ধিভ্রষ্ট হইয়া কুলক্ষয়ের দোষ ও মিত্রের অনিষ্টকরণে মহাপাপ বুঝেন না,
আমরা, জনার্দন, কুলক্ষয়জনিত দোষ বুঝি, কেন আমাদের জ্ঞান হইবে না, এই পাপ হইতে আমরা কেন নিবৃত্ত হইব না?
কুলক্ষয়ে প্রণশ্যন্তি কুলধৰ্ম্মাঃ সনাতনাঃ ৷ ধৰ্ম্মে নষ্টে কুলং কৃৎস্নমধৰ্ম্মোহভিভবত্যুত ॥৩৯॥
কুলক্ষয়ে সনাতন কুলধৰ্ম্ম সকল বিনাশপ্রাপ্ত হয়, ধৰ্মনাশে অধৰ্ম্ম সমস্ত কুলকে অভিভূত করে ৷
অধৰ্ম্মাভিভবাৎ কৃষ্ণ প্ৰদুষ্যন্তি কুলস্ত্রিয়ঃ ৷ স্ত্রী দুষ্টাসুবাষ্ণেয় জায়তে বর্ণসঙ্করঃ ॥৪০॥
অধৰ্ম্মের অভিভবে হে কৃষ্ণ, কুলস্ত্রীগণ দুশ্চরিত্রা হয় ৷ কুলস্ত্রীগণ দুশ্চরিত্রা হইলে বর্ণসঙ্কর হয় ৷
সঙ্করাে নরকায়ৈব কুলাঘানাং কুলস্য চ ৷ পতন্তি পিতরাে হেষাং লুপ্তপিণ্ডোদকক্রিয়াঃ ॥৪১॥
বর্ণসঙ্কর কুল ও কুলনাশকগণের নরক প্রাপ্তির হেতু, কেননা তাহাদের পিতৃপুরুষগণ পিণ্ডোদক হইতে বঞ্চিত হইয়া পিতৃলােক হইতে পতিত হন ৷
দোষৈরেতৈঃ কুলঘানাং বর্ণসঙ্করকারকৈঃ ৷ উৎসাদ্যন্তে জাতিধৰ্ম্মাঃ কুলধৰ্ম্মাশ্চ শাশ্বতাঃ ॥৪২॥
কুলনাশকদের এই বর্ণসঙ্করােৎপাদক দোষ সকলের ফলে সনাতন জাতিধৰ্ম্ম সকল ও কুলধৰ্ম্ম সকল উৎসন্ন হয় ৷
উৎসন্নকুলধৰ্ম্মাণাং মনুষ্যাণাং জনার্দন ৷ নরকে নিয়তং বাসাে ভবতীত্যনুশুশ্রম ॥৪৩॥
যাঁহাদের কুলধৰ্ম্ম উৎসন্ন হইয়াছে, সেই মনুষ্যদের নিবাস নরকে নির্দিষ্ট হয়, ইহাই প্রাচীনকাল হইতে শুনিয়া আসিতেছি ৷
অহাে বত মহৎ পাপং কং ব্যবসিতা বয়ম্ ৷ যদ্রাজ্যসুখলােভেন হন্তুং স্বজনমুদ্যতাঃ ॥৪৪॥
অহাে! আমরা অতি মহৎ পাপ করিতে কৃতনিশ্চয় হইয়াছিলাম, যে রাজ্য-সুখের লােভে স্বজনকে বধ করিতে উদ্যম করিতেছিলাম ৷
যদি মামপ্রতীকারমশস্ত্রং শস্ত্রপাণয়ঃ ৷ ধার্তরাষ্ট্রা রণে হস্তন্যে ক্ষেমতরং ভবেৎ ॥৪৫॥
যদি অশস্ত্র ও প্রতিকারে অনুদ্যোগী আমাকে সশস্ত্র ধার্তরাষ্ট্রগণ রণে সংহার করেন, তাহাই ইহা অপেক্ষা আমার মঙ্গল ৷”
এবমুক্বাৰ্জ্জুনঃ সংখ্যে রথােপস্থ উপাবিশৎ ৷ বিসৃজ্য সশরং চাপং শােকসংবিগ্নমানসঃ ॥৪৬॥
এই বলিয়া অৰ্জ্জুন শােকোদ্বেগে কলুষিতচিত্ত হইয়া যুদ্ধকালে আরূঢ়শর ধনু পরিত্যাগপূর্বক রথে বসিয়া পড়িলেন ৷
সঞ্জয়ের দিব্যচক্ষুপ্রাপ্তি
গীতা মহাভারতের মহাযুদ্ধের প্রারম্ভে উক্ত হয় ৷ অতএব গীতার প্রথম শ্লোকে দেখি রাজা ধৃতরাষ্ট্র দিব্যচক্ষুপ্রাপ্ত সঞ্জয়ের নিকট যুদ্ধের বার্তা জিজ্ঞাসা করিতেছেন ৷ দুই সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত, তাহাদের প্রথম চেষ্টা কি, বৃদ্ধ রাজা তাহা জানিতে উৎসুক ৷ সঞ্জয়ের দিব্যচক্ষুপ্রাপ্তির কথা আধুনিক ভারতের ইংরাজী-শিক্ষাপ্রাপ্ত শিক্ষিত লােকের চোখে কবির কল্পনা ভিন্ন আর কিছুই নহে ৷ যদি বলিতাম অমুক লােক দূরদৃষ্টি (Clairvoyance) ও দূরশ্রবণ (Clairaudience) প্রাপ্ত হইয়া দূরস্থ রণক্ষেত্রের লােমহর্ষণ দৃশ্য ও মহারথীগণের সিংহনাদ ইন্দ্রিয়গােচর করিতে পারিয়াছিলেন, তাহা হইলে বােধ হয় কথাটী তত অবিশ্বাসযােগ্য না-ও হইতে পারিত ৷ আর ব্যাসদেব যে এই শক্তি সঞ্জয়কে প্রদান করিয়াছিলেন, তাহা আরও আষাঢ়ে গল্প বলিয়া উড়াইতে প্রবৃত্তি হয় ৷ যদি বলিতাম যে একজন বিখ্যাত য়ুরােপীয় বিজ্ঞানবিদ অমুক লােককে স্বপ্নাবস্থাপ্রাপ্ত (Hypnotised) করিয়া তাহার মখে সেই দর ঘটনার কতক বর্ণনা অবগত হইয়াছিলেন, তাহা হইলেই যাহারা পাশ্চাত্য hypnotismএর কথা মনােযােগের সহিত পড়িয়াছেন, তাহারা বিশ্বাস কারতেও পারিতেন ৷ অথচ hypnotism যােগশক্তির নিকৃষ্ট ও বর্জনীয় অঙ্গ মাত্র ৷ মানুষের মধ্যে এমন অনেক শক্তি নিহিত রহিয়াছে যে পূর্বকালের সভ্য জাতি সেই সকল জানিত ও বিকাশ করিত; কিন্তু কলিসভৃত অজ্ঞানের স্রোতে সেই বিদ্যা ভাসিয়া গিয়াছে, কেবল আংশিকরূপে অল্প লােকের মধ্যে গুপ্ত ও গােপনীয় জ্ঞান বলিয়া রক্ষিত হইয়া আসিতেছে ৷ সূক্ষ্মদৃষ্টি বলিয়া স্থল ইন্দ্রিয়াতীত সূক্ষ্মেন্দ্রিয় আছে যাহা দ্বারা আমরা স্থল ইন্দ্রিয়ের আয়ত্তাতীত পদার্থ ও জ্ঞান আয়ত্ত করিতে পারি, সূক্ষ্ম বস্তু দর্শন, সূক্ষ্ম শব্দ শ্রবণ, সূক্ষ্ম গন্ধ আঘ্রাণ, সূক্ষ্ম পদার্থ স্পর্শ ও সূক্ষ্ম আহার আস্বাদ করিতে পারি ৷ সূক্ষ্মদৃষ্টির চরম পরিণামকে দিব্যচক্ষু বলে, তাহার প্রভাবে দূরস্থ, গুপ্ত বা অন্যলােকগত বিষয় সকল আমাদের জ্ঞানগােচর হয় ৷ পরম যােগশক্তির আধার মহামুনি ব্যাস যে এই দিব্যচক্ষু সঞ্জয়কে দিতে সক্ষম ছিলেন, তাহা অবিশ্বাস করিবার কোনও কারণ দেখিতে পাই না ৷ পাশ্চাত্য hypnotistএর অদ্ভুত শক্তিতে যদি আমরা অবিশ্বাসী হই না, তবে অতুল্য জ্ঞানী ব্যাসদেবের শক্তিতে অবিশ্বাসী হইব কেন? শক্তিমানের শক্তি পরের শরীরে সংক্রামিত হইতে পারে, তাহার ভূরি ভূরি প্রমাণ ইতিহাসের প্রত্যেক পৃষ্ঠায় ও মনুষ্য-জীবনের প্রত্যেক কাৰ্য্যে পাওয়া যায় ৷ নেপােলিয়ন, ইতাে প্রভৃতি কৰ্ম্মবীর উপযুক্ত পাত্রে শক্তি সংক্রমণের দ্বারা তাহাদের কাৰ্য্যের সহকারী প্রস্তুত করিয়াছেন ৷ অতি সামান্য যােগীও কোন সিদ্ধি প্রাপ্ত হইয়া কয়েকক্ষণের জন্য বা কোনও বিশেষ কাৰ্য্যে প্রয়ােগ করিবার জন্য পরকে স্বীয় সিদ্ধি প্রদান করিতে পারেন, – ব্যাসদেব ত জগতের শ্রেষ্ঠ মনীষী ও অসামান্য যােগসিদ্ধ পুরুষ ৷ বাস্তবিক, দিব্যচক্ষুর অস্তিত্ব আষাঢ়ে গল্প না হইয়া বৈজ্ঞানিক সত্য হইবার কথা ৷ আমরা জানি, চক্ষু দর্শন করে না, কর্ণ শ্রবণ করে না, নাসিকা আঘ্রাণ করে না, ত্বক স্পর্শ উপলব্ধি করে না, রসনা আস্বাদ করে না ৷ মনই দর্শন করে, মনই শ্রবণ করে, মনই আঘ্রাণ করে, মনই স্পর্শ উপলব্ধি করে, মনই আস্বাদ করে ৷ দর্শন শাস্ত্রে ও মনস্তত্ত্ববিদ্যায় এই সত্য অনেকদিন হইতে গৃহীত হইয়া আসিয়াছে, hypnotismএ ইহা বৈজ্ঞানিক প্রয়ােগ দ্বারা পরীক্ষিত হইয়া প্রমাণিত হইয়াছে, যে চক্ষু মুদ্রিত হইলেও দর্শনেন্দ্রিয়ের কাৰ্য্য যে কোন নাড়ী দ্বারা সম্পাদিত হইতে পারে ৷ তাহাতে ইহাই প্রতিপন্ন হয় যে চক্ষু ইত্যাদি স্থলেন্দ্রিয় জ্ঞানপ্রাপ্তির কেবল সুবিধাজনক উপায়, স্থূল শরীরের সনাত অভ্যাসে বদ্ধ হইয়া আমরা তাহাদের দাস হইয়াছি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যে কোন শারীরিক প্রণালী দ্বারা সেই জ্ঞান মনে পৌঁছাইতে পারি – যেমন অন্ধ স্পর্শ দ্বারা পদার্থের আকৃতির ও স্বভাবের নির্ভুল ধারণা করে ৷ কিন্তু অন্ধের দৃষ্টি ও স্বপ্নাবস্থাপ্রাপ্ত ব্যক্তির দৃষ্টিতে এই প্রভেদ লক্ষ্য করা যায় যে স্বপ্নাবস্থাপ্রাপ্ত ব্যক্তি পদার্থের প্রতিমূৰ্ত্তি মনের মধ্যে দেখে ৷ ইহাকেই দর্শন বলে ৷ প্রকৃতপক্ষে আমি সম্মুখস্থিত পুস্তক দর্শন করি না, সেই পুস্তকের যে প্রতিমূৰ্ত্তি আমার চক্ষুতে চিত্রিত হয়, তাহাই দেখিয়া মন বলে, পুস্তক দেখিলাম ৷ কিন্তু স্বপ্নাবস্থাপ্রাপ্তের দূরস্থ পদার্থ বা ঘটনা দর্শনে ও শ্রবণে ইহাও প্রতিপন্ন হয় যে, পদার্থজ্ঞানপ্রাপ্তির জন্য কোন শারীরিক প্রণালীর আবশ্যকতা নাই, – সূক্ষ্মদৃষ্টি দ্বারা দর্শন করিতে পারি ৷ লণ্ডনে ঘরে বসিয়া সে সময় এডিনবরােতে যে ঘটনা হইতেছে, মনের মধ্যে তাহা দেখিলাম, এইরূপ দৃষ্টান্তের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাইতেছে ৷ ইহাকেই সূক্ষ্মদৃষ্টি বলে ৷ সূক্ষ্মদৃষ্টিতে ও দিব্যচক্ষুতে এই প্রভেদ আছে যে, সূক্ষ্মদর্শী মনের মধ্যে অদৃষ্ট পদার্থের প্রতিমূর্তি দর্শন করে, দিব্যচক্ষু দ্বারা আমরা মনের মধ্যে সেই দৃশ্য না দেখিয়া, শারীরিক চক্ষের সম্মুখে দেখি, চিন্তাস্রোতে সেই শব্দ না শুনিয়া শারীরিক কর্ণে শুনি ৷ ইহার এক সামান্য দৃষ্টান্ত Crystalএ বা কালির মধ্যে সমসাময়িক ঘটনা দেখা ৷ কিন্তু দিব্যচক্ষুপ্রাপ্ত যােগীর পক্ষে এইরূপ উপকরণের কোন আবশ্যকতা নাই, তিনি এই শক্তিবিকাশে বিনা উপকরণে দেশকালের বন্ধন খুলিয়া অন্য দেশের ও অন্য কালের ঘটনা অবগত হইতে পারেন ৷ দেশবন্ধন মােচনের প্রমাণ আমরা যথেষ্ট পাইয়াছি, কাল-বন্ধনও যে মােচন করা যায়, মানুষ যে ত্রিকালদর্শী হইতে পারে, তাহার এত বহুসংখ্যক ও সন্তোষজনক প্রমাণ এখনও জগতের সমক্ষে উপস্থিত করা হয় ৷ নাই ৷ তবে যদি দেশবন্ধন মােচন করা সম্ভব হয়, কালবন্ধন মােচন অসম্ভব কথা বলা যায় না ৷ যাহা হউক, এই ব্যাসদত্ত দিব্যচক্ষু দ্বারা সঞ্জয় হস্তিনাপুরে থাকিয়াও যেন কুরুক্ষেত্রে দাড়াইয়া সমবেত ধার্তরাষ্ট্র ও পাণ্ডবগণকে চক্ষে দেখিলেন, দুর্যোধনের উক্তি, পিতামহ ভীষ্মের ভীম সিংহনাদ, পাঞ্চজন্যের কুরুধ্বংসঘােষক মহাশব্দ ও গীতার্থদ্যোতক কৃষ্ণার্জুন-সংবাদ কর্ণে শ্রবণ করিলেন ৷
আমাদের মতে মহাভারতও রূপক নহে, কৃষ্ণ ও অর্জুনও কবির কল্পনা নহে, গীতাও আধুনিক তার্কিক বা দার্শনিকের সিদ্ধান্ত নহে ৷ অতএব গীতার কোনও কথা যে অসম্ভব বা যুক্তিবিরুদ্ধ নহে, তাহা প্রতিপন্ন করিতে হইবে ৷ এইজন্যই দিব্যচক্ষুপ্রাপ্তির কথার এত বিস্তৃত সমালােচনা করিলাম ৷
দুর্যোধনের বাকৌশল
সঞ্জয় সেই প্রথম যুদ্ধচেষ্টা বর্ণনা করিতে আরম্ভ করিলেন ৷ দুর্যোধন পাণ্ডবসৈন্য রচিত ব্যুহ দেখিয়া দ্রোণাচার্য্যের নিকট উপস্থিত হইলেন ৷ কেন দ্রোণের নিকট গেলেন তাহার ব্যাখ্যা আবশ্যক ৷ ভীষ্মই সেনাপতি, যুদ্ধের কথা তাহাকেই বলা উচিত ছিল, কিন্তু কূটবুদ্ধি দুর্যোধনের মনে ভীষ্মের উপর বিশ্বাস ছিল না ৷ ভীষ্ম পাণ্ডবদের অনুরক্ত, হস্তিনাপুরের শান্তনুমােদক দলের (peace party) নেতা; যদি পাণ্ডবে ধার্তরাষ্ট্রেই যুদ্ধ হইত, ভীষ্ম কখনই অস্ত্রধারণ করিতেন না; কিন্তু কুরুদের প্রাচীন শত্রু ও সমকক্ষ সাম্রাজ্যলিঙ্গু পাঞ্চালজাতি দ্বারা কুরুরাজ্য আক্রান্ত দেখিয়া কুরুজাতির প্রধান পুরুষ, যােদ্ধা ও রাজনীতিবিদ সেনাপতিপদে নিযুক্ত হইয়া স্বীয় বাহুবলে চিররক্ষিত স্বজাতির গৌরব ও প্রাধান্যের শেষরক্ষা করিতে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছিলেন ৷ দুর্যোধন স্বয়ং অসুরপ্রকৃতি, রাগদ্বেষই তাহার সর্বকাৰ্য্যের প্রমাণ ও হেতু, অতএব কর্তব্যপরায়ণ মহাপুরুষের মনের ভাব বুঝিতে অক্ষম, কওঁব্যবুদ্ধিতে প্রাণপ্রতিম পাণ্ডবগণকেও যুদ্ধক্ষেত্রে সংহার করিবার বল এই কঠিন তপস্বীর প্রাণে আছে, তাহা কখনও বিশ্বাস করিতে পারেন নাই ৷ স্বদেশহিতৈষী পরামর্শের সময়ে স্বীয় মত প্রকাশপূৰ্ব্বক স্বজাতিকে অন্যায় ও অহিত হইতে নিবৃত্ত করিতে প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াও সেই অন্যায় ও অহিত একবার লােকদ্বারা স্বীকৃত হইলে স্বীয় মত উপেক্ষা করিয়া অধৰ্ম্মযুদ্ধেও স্বজাতি-রক্ষা ও শত্রুদমন করেন, ভীষ্মও সেই পক্ষ অবলম্বন করিয়াছিলেন ৷ এই ভাবও দুর্যোধনের বােধাতীত ৷ অতএব ভীষ্মের নিকট উপস্থিত না হইয়া দ্রোণকে স্মরণ করিলেন ৷ দ্রোণ ব্যক্তিগতভাবে পাঞ্চালরাজের ঘাের শত্রু, পাঞ্চাল দেশের রাজকুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন গুরু দ্রোণকে বধ করিতে কৃতপ্রতিজ্ঞ, অর্থাৎ দুর্যোধন ভাবিলেন, এই ব্যক্তিগত বৈরভাবের কথা স্মরণ করাইলে আচাৰ্য্য শান্তির পক্ষপাত পরিত্যাগ করিয়া পূর্ণ উৎসাহে যুদ্ধ করিবেন ৷ স্পষ্ট সেই কথা বলিলেন না ৷ ধৃষ্টদ্যুম্নের নামমাত্র উল্লেখ করিলেন, তাহার পরে ভীষ্মকেও সন্তুষ্ট করিবার জন্য তাঁহাকে কুরুরাজ্যের রক্ষক ও বিজয়ের আশাস্বরূপ বলিয়া নির্দিষ্ট করিলেন ৷ প্রথম বিপক্ষের মুখ্য মুখ্য যােদ্ধার নাম উল্লেখ করিলেন, পরে স্বসৈন্যের কয়েকজন নেতার নাম বলিলেন, সকলের নহে, দ্রোণ ও ভীষ্মের নামই তাহার অভিসন্ধি সিদ্ধ্যর্থ যথেষ্ট, তবে সেই অভিসন্ধি গােপন করিবার জন্য আর চারি-পাঁচটী নাম বলিলেন ৷ তাহার পরে বলিলেন, “আমার সৈন্য অতি বৃহৎ, ভীষ্ম আমার সেনাপতি, পাণ্ডবদের সৈন্য অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র, তাহাদের আশাস্থল ভীমের বাহুবল, অতএব আমাদের জয় হইবে না কেন? তবে ভীষ্মই যখন আমাদের প্রধান ভরসা, তাহাকে শত্রু-আক্রমণ হইতে রক্ষা করা সকলের উচিত, তিনি থাকিলে আমাদের জয় অবশ্যম্ভাবী ৷” অনেকে “অপৰ্য্যাপ্ত” শব্দের বিপরীত অর্থ করেন, তাহা যুক্তিসঙ্গত নহে, দুর্যোধনের সৈন্য অপেক্ষাকৃত বৃহৎ, সেই সৈন্যের নেতাগণ শৌর্য্যে বীর্য্যে কাহারও নূন নহেন, আত্মশ্লাঘী দুর্যোধন কেন স্ববলের নিন্দা করিয়া নিরাশা উৎপাদন করিতে যাইবেন? ভীষ্ম দুর্যোধনের মনের ভাব ও কথার গূঢ় উদ্দেশ্য বুঝিতে পারিয়া তাহার সন্দেহ অপনােদনার্থ সিংহনাদ ও শঙ্খনাদ করিলেন ৷ দুর্যোধনের হৃদয়ে তাহাতে হর্ষোৎপাদন হইল ৷ তিনি ভাবিলেন, আমার উদ্দেশ্য সাধিত হইয়াছে, দ্রোণ ও ভীষ্ম দ্বিধা দূর করিয়া যুদ্ধ করিবেন ৷
পূর্ব সূচনা
যেই ভীষ্মের গগনভেদী শঙ্খনাদে রণক্ষেত্র কম্পিত হইল, তখনই সেই বিশাল কৌরব সেনার চারিদিক হইতে রণবাদ্য বাজিয়া উঠিল এবং রণােল্লাসে রথীগণ মাতিতে লাগিল ৷ অপরদিকে পাণ্ডবদের শ্রেষ্ঠ বীর ও তঁাহার সারথি শ্রীকৃষ্ণ ভীষ্মের যুদ্ধাহ্বানের উত্তরস্বরূপ শঙ্খনাদ করিলেন এবং যুধিষ্ঠির প্রভৃতি পাণ্ডব-পক্ষীয় বীরগণ স্ব স্ব শঙ্খ বাজাইয়া রণচণ্ডীকে সৈন্যের হৃদয়ে জাগাইলেন ৷ সেই মহান্ শব্দ পৃথিবী ও নভঃস্থলকে ধ্বনিত করিয়া যেন ধার্তরাষ্ট্রগণের হৃদয় বিদীর্ণ করিল ৷ ইহার এই অর্থ নহে যে ভীষ্ম প্রভৃতি এই শব্দে ভীত হইলেন, তাহারা বীরপুরুষ, রণচণ্ডীর আহ্বানে ভীত হইবেন কেন? এই উক্তিতে কবি প্রথম অত্যুৎকট শব্দের শারীরিক বেগবান সঞ্চার বর্ণনা করিয়াছেন, যেমন বজ্রনাদ অনেকবার মস্তক দ্বিখণ্ডিত করিয়া যায় এইরূপ শ্রোতার বােধ হয়, তেমনই এই রণক্ষেত্রব্যাপী মহাশব্দের সঞ্চার হইল; আর এই শব্দ যেন ধার্তরাষ্ট্রগণের ভাবী নিধনের ঘােষণা, যেই হৃদয়গুলি পাণ্ডবদের শস্ত্র বিদীর্ণ করিবে, পূর্বেই তাহাদের শঙ্খনাদ বিদীর্ণ করিয়া গেল ৷ যুদ্ধ আরম্ভ হইল, দুই দিক হইতে শস্ত্রনিক্ষেপ হইতে লাগিল, এই সময়ে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে বলিলেন, “তুমি আমার রথ দুই সৈন্যের মধ্যভাগে স্থাপন কর, আমি দেখিতে ইচ্ছা করি, কে কে বিপক্ষ, কাহারা যুদ্ধে দুর্বুদ্ধি দুর্যোধনের প্রিয়কৰ্ম্ম করিতে সমাগত হইয়াছেন, কাহাদের সঙ্গে আমাকে যুদ্ধ করিতে হইবে ৷” অর্জুনের ভাব এই যে আমিই পাণ্ডবদের আশাস্থল, আমা দ্বারাই বিপক্ষের প্রধান প্রধান যােদ্ধা হন্তব্য, অতএব দেখি ইহারা কাহারা ৷ এই পৰ্য্যন্ত অর্জনের সম্পূর্ণ ক্ষত্রিয়ভাব রহিয়াছে, কৃপা কিম্বা দৌর্বল্যের কোন চিহ্ন নাই ৷ ভারতের অনেক শ্রেষ্ঠ বীরপুরুষ বিপক্ষের সৈন্যে উপস্থিত, সকলকে সংহার করিয়াঅর্জ্জুন জ্যেষ্ঠভ্রাতা যুধিষ্টিরকেঅসপত্ন সাম্রাজ্য দিবার জন্য উদ্যোগী ৷ কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ জানেন যে অৰ্জ্জুনের মনে দৌর্বল্য আছে, এখন চিত্ত পরিষ্কার না করিলে এমন কোনও সময়ে অকস্মাৎ চিত্ত হইতে বুদ্ধিতে উঠিয়া অধিকার করিতে পারে যে পাণ্ডবদের বিশেষ অনিষ্ট, হয় ত সর্বনাশ হইবে ৷ সেইজন্য শ্রীকৃষ্ণ এমন স্থানে রথ স্থাপন করিলেন যে ভীষ্ম দ্রোণ ইত্যাদি অর্জুনের প্রিয়জন তাহার সম্মুখে রহিলেন অথচ আর সকল কৌরবপক্ষীয় নৃপতিকে দেখিতে পান, এবং তাঁহাকে বলিলেন, দেখ, সমবেত কুরুজাতিকে দেখ ৷ স্মরণ করিতে হয় যে অৰ্জ্জুন স্বয়ং কুরুজাতীয়, কুরুবংশের গৌরব, তাঁহার সকল আত্মীয়, প্রিয়জন, বাল্যের সহচরগণ সেই কুরুজাতীয়, তাহা হইলে শ্রীকৃষ্ণের মুখে এই তিনটী সামান্য কথার গভীর অর্থ ও ভাব হৃদয়ঙ্গম হয় ৷ তখন অৰ্জ্জুন দেখিলেন যাঁহাদের সংহার করিয়া যুধিষ্ঠিরের অসপত্ন রাজ্য স্থাপন করিতে হইবে, তাহারা আর কেহ নন, নিজ প্রিয় আত্মীয়, গুরু, বন্ধু, ভক্তি ও ভালবাসার পাত্র ৷ দেখিলেন সমস্ত ভারতের ক্ষত্রিয়বংশ পরস্পরের সহিত প্রিয় সম্বন্ধ দ্বারা আবদ্ধ অথচ পরস্পরকে সংহার করিতে এই ভীষণ রণক্ষেত্রে আগত ৷
বিষাদের মূল কারণ
অর্জুনের নিৰ্ব্বেদের মূল কি? অনেকে এই বিষাদের প্রশংসা করিয়া শ্রীকৃষ্ণকে কুমাৰ্গপ্রদর্শক ও অধৰ্ম্মের অনুমােদক বলিয়া নিন্দা করেন ৷ খ্রীষ্টধৰ্ম্মের শান্তিভাব, বৌদ্ধধৰ্ম্মের অহিংসাভাব এবং বৈষ্ণবধৰ্ম্মের প্রেমভাবই উচ্চ ও শ্রেষ্ঠ ধৰ্ম্ম, যুদ্ধ ও নরহত্যা পাপ, ভ্রাতৃহত্যা ও গুরুহত্যা মহাপাতক, তাহারা এই ধারণার বশবর্তী হইয়া এই অসঙ্গত কথা বলেন ৷ কিন্তু এই সকল আধুনিক ধারণা দ্বাপর যুগের মহাবীর পাণ্ডবের মনেও উঠে নাই; অহিংসাভাব শ্রেষ্ঠ, বা যুদ্ধ, নরহত্যা, ভ্রাতৃহত্যা ও গুরুহত্যা মহাপাপ বলিয়া যুদ্ধে বিরত হওয়া উচিত, এই চিন্তার কোনও চিহ্নও অর্জুনের কথায় ব্যক্ত হয় না ৷ বলিলেন বটে, গুরুজনকে হত্যা করা অপেক্ষা ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করা শ্রেয়স্কর, বলিলেন বটে যে বন্ধুবান্ধবের হত্যায় পাপ আমাদিগকে আশ্রয় করিবে, কিন্তু কর্মের স্বভাব দেখিয়া এই কথা বলেন নাই, কর্মের ফল দেখিয়া বলিলেন; সেইজন্য শ্রীকৃষ্ণ তাহার বিষাদ ভঞ্জনার্থ এই শিক্ষা দিয়াছেন যে কর্মের ফল দেখিতে নাই, কর্মের স্বভাব দেখিয়া সেই কৰ্ম্ম করা উচিত না অনুচিত স্থির করিতে হয় ৷ অর্জুনের প্রথম ভাব এই যে ইহারা আমার আত্মীয়, গুরুজন, বন্ধু, বাল্যসহচর, সকলে স্নেহ, ভক্তি ও ভালবাসার পাত্র, ইহাদের হত্যায় অসপত্ন রাজ্যলাভ করিলে সেই রাজ্যভােগ কদাচ সুখপ্রদ হইতে পারে না, বরং যাবজ্জীবন দুঃখ ও পশ্চাত্তাপে দগ্ধ হইতে হয়, বন্ধুবান্ধবশূন্য পৃথিবীর রাজ্য কাহারও বাঞ্ছনীয় নহে ৷ অর্জুনের দ্বিতীয় ভাব এই যে প্রিয়জনকে হত্যা করা ধৰ্ম্মবিরুদ্ধ, যাঁহারা দ্বেষের পাত্র, তাহাদিগকে যুদ্ধে হত্যা করা ক্ষত্রিয়ের ধৰ্ম্ম ৷ তৃতীয় ভাব এই যে স্বার্থের জন্য এইরূপ কৰ্ম্ম করা ধৰ্ম্মবিরুদ্ধ ও ক্ষত্রিয়ের অনুচিত ৷ চতুর্থ ভাব এই যে ভ্রাতৃবিরােধে ও ভ্রাতৃহত্যায় কুলনাশ ও জাতিধ্বংস ঘটিবে, এইরূপ কুফল সৃষ্টি কুলরক্ষক ও জাতিরক্ষক ক্ষত্রিয়বীরের পক্ষে মহাপাপ ৷ এই চারটী ভাব ভিন্ন অর্জুনের বিষাদের মূলে আর কোনও ভাব নাই ৷ ইহা না বুঝিলে শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্য ও শিক্ষার অর্থও বুঝা যায় না ৷ খ্রীষ্টধর্ম, বৌদ্ধধৰ্ম্ম, বৈষ্ণবধৰ্ম্মের সহিত গীতার ধর্মের বিরােধ ও সামঞ্জস্যের কথা পরে বলা হইবে ৷ অর্জুনের কথার ভাব সূক্ষ্মবিচারে নিরীক্ষণ করিয়া তাহার মনের ভাব প্রদর্শন করি ৷
বৈষ্ণবী মায়ার আক্রমণ
অর্জুন প্রথম তাহার বিষাদের বর্ণনা করিলেন ৷ স্নেহ ও কৃপার অকস্মাৎ বিদ্রোহে মহাবীর অর্জুন অভিভূত ও পরাস্ত, তাহার শরীরের সমস্ত বল এক মুহূর্তে শুকাইয়া গিয়াছে, অঙ্গ সকল অবসন্ন, দাড়াইবার শক্তিও নাই, বলবানের হস্ত গাণ্ডীব ধারণে অসমর্থ, শােকের উত্তাপে জ্বরের লক্ষণ ব্যক্ত, শরীরের দৌর্বল্য হইয়াছে, ত্বক যেন অগ্নিতে দগ্ধ হইতেছে, মুখ ভিতরে শুকাইয়া গিয়াছে, সমস্ত শরীর তীব্রভাবে কম্পমান, মন যেন সেই আক্রমণে ঘুরিতেছে ৷ এই ভাবের বর্ণনা পড়িয়া প্রথম কবির তেজস্বিনী কল্পনার অতিরিক্ত বিকাশ বলিয়া কেবল সেই কবিত্বসৌন্দৰ্য্য ভােগ করিয়া ক্ষান্ত হই; কিন্তু যদি সূক্ষ্মবিচারে নিরীক্ষণ করি, তখন এই বর্ণনার একটী গূঢ় অর্থ মনে উদয় হয় ৷ অর্জুন পূর্বেও কুরুদের সহিত যুদ্ধ করিয়াছেন, অথচ এইরূপ ভাব কখনও হয় নাই, এখন শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছায় হঠাৎ এই আন্তরিক উৎপাত হইয়াছে ৷ মনুষ্যজাতির অনেক অতিপ্রবল বৃত্তি ক্ষত্রিয় শিক্ষা ও উচ্চ আকাঙ্ক্ষা দ্বারা পরাভূত ও আবদ্ধ হইয়া অৰ্জ্জুনের ৷ হৃদয়তলে গুপ্তভাবে রহিয়াছে ৷ নিগ্রহ দ্বারা চিত্তশুদ্ধি হয় না, বিবেক ও বিশুদ্ধ বুদ্ধির সাহায্যে সংযমে চিত্তশুদ্ধি হয় ৷ নিগৃহীত বৃত্তি ও ভাবসকল হয় এই জন্মে, নহে পরজন্মে একদিন চিত্ত হইতে উঠিয়া বদ্ধিকে আক্রমণ করে এবং জয় করিয়া সমস্ত কৰ্ম্ম স্ববিকাশের অনুকূল পথে চালায় ৷ এই হেতু, যে এই জন্মে দয়াবান, সে অন্য জন্মে নিষ্ঠুর হয়, যে এই জন্মে কামী ও দুশ্চরিত্র, সে অন্য জন্মে সাধু ও পবিত্রচেতা হয় ৷ নিগ্রহ না করিয়া বিবেক ও বিশুদ্ধ বুদ্ধির সাহায্যে বৃত্তিগুলি প্রত্যাখ্যান করিয়া চিত্ত পরিষ্কার করিতে হয় ৷ ইহাকেই সংযম বলে ৷ জ্ঞানের প্রভাবে তমােভাবের অপনােদন না হইলে সংযম অসম্ভব ৷ সেইজন্য শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের অজ্ঞান দূর করিয়া সুপ্ত বিবেক জাগাইয়া চিশােধন করিতে ইচ্ছুক ৷ কিন্তু পরিহার্য্য বৃত্তিসকল চিত্ত হইতে উত্তোলনপূর্বক বুদ্ধির সম্মুখে উপস্থিত না করিলে বুদ্ধিও প্রত্যাখ্যান করিবার অবসর পায় না, উপরন্তু যুদ্ধেই অন্তঃস্থ দৈত্য ও রাক্ষস বিবেক দ্বারা হত হয়, তখন বিবেক বুদ্ধিকে মুক্ত করে ৷ যােগের প্রথম অবস্থায় যত কুপ্রবৃত্তি চিত্তে বদ্ধমূল হইয়া রহিয়াছে, প্রবল বেগে বুদ্ধিকে আক্রমণ করিয়া অনভ্যস্ত সাধককে ভীতি ও শােকে বিহ্বল করিয়া ফেলে, ইহাকেই পাশ্চাত্য দেশে বলে শয়তানের প্রলােভন, ইহাই মারের আক্রমণ ৷ কিন্তু সেই ভীতি ও শােক অজ্ঞানসম্ভুত, সেই প্রলােভন শয়তানের নহে, ভগবানের ৷ অন্তৰ্য্যামী জগৎগুরুই সেই সকল প্রবৃত্তি সাধককে আক্রমণ করিবার জন্য আহ্বান করেন, অমঙ্গলের জন্য নহে, মঙ্গলের জন্য, চিত্তশােধনের জন্য ৷ শ্রীকৃষ্ণ যেমন সশরীরে বাহ্যজগতে অৰ্জ্জুনের সখা ও সারথি, তেমনই তাহার মধ্যে অশরীরী ঈশ্বর ও অন্তর্যামী পুরুষােত্তম, তিনিই এই গুপ্ত বৃত্তি ও ভাব প্রবলবেগে এক সময় বুদ্ধির উপর নিক্ষেপ করিলেন ৷ সেই ভীষণ আঘাতে বুদ্ধি ঘূর্ণমান হইল এবং প্রবল মানসিক বিকার তৎক্ষণাৎ স্থল শরীরে কবিবর্ণিত লক্ষণ সকলে ব্যক্ত হইল ৷ প্রবল অপ্রত্যাশিত শােক-দুঃখের এইরূপ শারীরিক বিকাশ হয়, তাহা আমরা জানি, তাহা মনুষ্যজাতির সাধারণ অনুভবের বহির্ভূত নহে ৷ অর্জুনকে ভগবানের বৈষ্ণবী মায়া অখণ্ড বলে এক মুহূর্তে অভিভূত করিল, সেইজন্য এই প্রবল বিকার ৷ যখন অধৰ্ম্ম দয়া প্রেম ইত্যাদি কোমল ধৰ্ম্মের আকার ধারণ করিয়া, অজ্ঞান জ্ঞানের বেশে ছদ্মবেশী হইয়া আসে, গাঢ় কৃষ্ণ তমােগুণ উজ্জ্বল ও বিশদ পবিত্রতার ভাণ করিয়া বলে, আমি সাত্ত্বিক, আমি জ্ঞান, আমি ধৰ্ম্ম, আমি ভগবানের প্রিয় দূত, পুণ্যরূপী পুণ্যপ্রবর্তক, তখন বুঝিতে হইবে যে ভগবানের বৈষ্ণবী মায়া বুদ্ধির মধ্যে প্রকাশ হইয়াছে ৷
বৈষ্ণবী মায়ার লক্ষণ
এই বৈষ্ণবী মায়ার মুখ্য অস্ত্র কৃপা ও স্নেহ ৷ মানবজাতির প্রেম ও ভালবাসা বিশুদ্ধ বৃত্তি নহে, শারীরিক ও প্রাণকোশাগত বিকারের বশে পবিত্র প্রেম ও দয়া কলুষিত ও বিকলাঙ্গ হয় ৷ চিত্তই বৃত্তির বাসস্থান, প্রাণ ভােগের ক্ষেত্র, শরীর কৰ্ম্মের যন্ত্র, বুদ্ধি চিন্তার রাজ্য ৷ বিশুদ্ধ অবস্থায় এই সকলের স্বতন্ত্র অথচ পরস্পরের অবিরােধী প্রবৃত্তি হয়, চিত্তে ভাব ওঠে, শরীর দ্বারা তদনুযায়ী কর্ম হয়, বুদ্ধিতে তৎসম্পর্কীয় চিন্তা হয়, প্রাণ সেই ভাব, কর্ম ও চিন্তার আনন্দ ভােগ করে, জীব সাক্ষী হইয়া প্রকৃতির এই আনন্দময় ক্রীড়াদর্শনে আনন্দলাভ করে ৷ অশুদ্ধ অবস্থায় প্রাণ শারীরিক বা মানসিক ভােগের জন্য লালায়িত হইয়া শরীরকে কৰ্ম্মযন্ত্র না করিয়া ভােগের উপায় করে, শরীর ভােগে আসক্ত হইয়া বার বার শারীরিক ভােগের জন্য দাবী করে, চিত্ত শারীরিক ভােগের কামনায় আক্রান্ত হইয়া আর নির্মল ভাব গ্রহণে অক্ষম হয়, কলুষিত বাসনাযুক্ত ভাব চিত্তসাগর বিক্ষুব্ধ করে, সেই বাসনার কোলাহল বুদ্ধিকে অভিভূত করিয়া বিব্রত করে, বধির করে, বুদ্ধি আর নির্মল, শান্ত অভ্রান্ত চিন্তা গ্রহণে সমর্থ হয় না, চঞ্চল মনের বশীভূত হইয়া ভ্রমে, চিন্তাবিভ্রাটে, অনৃতের প্রাবল্যে অন্ধ হয় ৷ জীবও এই বুদ্ধিভ্রংশে হৃতজ্ঞান হইয়া সাক্ষীভাব ও নির্মল আনন্দভাবে বঞ্চিত হইয়া আধারের সহিত নিজ একত্ব স্বীকার করিয়া আমি দেহ, আমি প্রাণ, আমি চিত্ত, আমি বুদ্ধি এই ভ্রান্ত ধারণায় শারীরিক ও মানসিক সুখ-দুঃখে সুখী ও দুঃখী হয় ৷ অশুদ্ধ চিত্ত এই বিভ্রাটের মূল, অতএব চিত্তশুদ্ধি উন্নতির প্রথম সােপান ৷ এই অশুদ্ধতা কেবল তামসিক ও রাজসিক বৃত্তিকে কলুষিত করিয়া ক্ষান্ত হয় না, সাত্ত্বিক বৃত্তিকেও কলুষিত করে ৷ অমুক লােক আমার শারীরিক বা মানসিক ভােগের সামগ্রী, আমার ভাল লাগে, তাহাকেই চাই, তাহার বিরহে আমার ক্লেশ হয়, ইহা অশুদ্ধ প্রেম, শরীর ও প্রাণ চিত্তকে কলুষিত করিয়া নিৰ্ম্মল প্রেমকে বিকৃত করিয়াছে ৷ বুদ্ধিও সেই অশুদ্ধতার ফলে ভ্রান্ত হইয়া বলে, অমুক আমার স্ত্রী, ভাই, ভগ্নী, সখা, আত্মীয়, মিত্র, তাহাকেই ভালবাসিতে হয়, সেই প্রেম পুণ্যময়, সেই প্রেমের প্রতিকূল কাৰ্য্য যদি করি, তাহা পাপ, ক্রুরতা, অধৰ্ম্ম ৷ এইরূপ অশুদ্ধ প্রেমের ফলে এমন বলবতী কৃপা হয় যে প্রিয়জনের কষ্ট, প্রিয়জনের অনিষ্ট অপেক্ষা ধর্মকে জলাঞ্জলি দেওয়াও শ্রেয়স্কর বােধ হয়, শেষে এই কৃপার উপর আঘাত পড়ে বলিয়া ধৰ্ম্মকে অধৰ্ম্ম বলিয়া নিজ দৌৰ্ব্বল্যের সমর্থন করি ৷ এইরূপ বৈষ্ণবী মায়ার প্রমাণ অর্জুনের প্রত্যেক কথায় পাওয়া যায় ৷
বৈষ্ণবী মায়ার ক্ষুদ্রতা
অর্জুনের প্রথম কথা, ইহারা আমাদের স্বজন, আত্মীয়, ভালবাসার পাত্র, তাহাদিগকে যুদ্ধে হত্যা করিয়া আমাদের কি হিত সাধিত হইবে? বিজেতার গৰ্ব্ব, রাজার গৌরব, ধনীর সুখ? আমি এই সকল শূন্য স্বার্থ চাই না ৷ লােকের রাজ্য, ভােগ, জীবন প্রিয় হয় কেন? স্ত্রী, পুত্র, কন্যা আছেন বলিয়া, আত্মীয়স্বজনকে সুখে রাখিতে পারিব বলিয়া, বন্ধু-বান্ধবের সহিত ঐশ্বর্যের সুখে ও আমােদে দিন কাটাইতে পারিব বলিয়া এই সকল সুখ ও মহত্ত্ব লােভের বিষয় ৷ কিন্তু যাঁহাদের জন্য আমরা রাজ্য ভােগ ও সুখ চাই, তাহারাই আমাদের শত্রু হইয়া যুদ্ধে উপস্থিত ৷ তাঁহারা আমাদিগকে বরং বধ করিতে প্রস্তুত তথাপি আমাদের সহিত রাজ্য ও সুখ একত্র ভােগ করিতে সম্মত নন ৷ আমাকে বধ করুন, আমি কিন্তু তঁাহাদিগকে কখন বধ করিতে পারিব না ৷ যদি তাহাদের হত্যায় ত্রিলােকরাজ্য অধিকার করিতাম, তাহা হইলেও পারিতাম না, পৃথিবীর অসপত্ন সাম্রাজ্য কি ছার! স্থূলদর্শী লােক –
“ন কাজে বিজয়ং কৃষ্ণ ন চ রাজ্যং সুখানি চ ৷”
এবং
“এতান্ন হনুমিচ্ছামি ঘুতাে পি মধুসূদন ॥ অপি ত্রৈলােক্যরাজ্যস্য হেতােঃ কিং নু মহীকৃতে ৷”
এই উক্তিতে মােহিত হইয়া বলেন, “অহাে! অৰ্জ্জুনের কি মহান উদার নিঃস্বার্থ প্রেমময় ভাব ৷ রুধিরাক্ত ভােগ ও সুখ অপেক্ষা পরাজয়, মরণ, চিরদুঃখ তাহার বাঞ্ছনীয় ৷ কিন্তু যদি অর্জুনের মনের ভাব পরীক্ষা করি, আমরা বুঝিতে পারি যে অৰ্জ্জুনের ভাব অতি ক্ষুদ্র, দুর্বলতা-প্রকাশক, ক্লীবােচিত ৷ কুলের হিতার্থে বা প্রিয়জনের প্রেমে, কৃপার বশে, রক্তপাতের ভয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ ত্যাগ করা অনার্য্যের পক্ষে মহৎ উদার ভাব হইতে পারে, আৰ্য্যের পক্ষে তাহা মধ্যম ভাব, ধর্ম ও ভগবৎপ্রীতির জন্য স্বার্থত্যাগ করাই উত্তমভাব ৷ অপর পক্ষে কুলের হিতার্থে, প্রিয়জনের প্রেমে, কৃপার বশে, রক্তপাতের ভয়ে ধৰ্ম্ম পরিত্যাগ করা ৷ অধম ভাব ৷ ধর্ম ও ভগবৎপ্রীতির জন্য স্নেহ, কৃপা ও ভয় দমন করা প্রকৃত আৰ্য্যভাব ৷ এই ক্ষুদ্রভাবের সমর্থনার্থ অৰ্জ্জুন স্বজনহত্যার পাপ দেখাইয়া আবার বলিলেন, “ধাৰ্তরাষ্ট্রদের বধে আমাদের কি সখ, কি মনস্তষ্টি হইতে পারে? তাহারা আমাদের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, যদিও অন্যায় করেন ও আমাদের শত্রুতা করেন, রাজ্য অপহরণ করেন, সত্যভঙ্গ করেন, তাহাদের বধে আমাদের পাপই হইবে, সুখ হইবে না ৷” অৰ্জ্জুন ভুলিয়া গিয়াছিলেন যে, তিনি ধর্মযুদ্ধ করিতেছেন, নিজ সুখের জন্য বা যুধিষ্ঠিরের সুখের জন্য শ্রীকৃষ্ণ দ্বারা ধার্তরাষ্ট্রবধে নিযুক্ত হন নাই, ধৰ্ম্মস্থাপন, অধৰ্ম্মনাশ, ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্ম পালন, ভারতে ধর্মপ্রতিষ্ঠিত এক মহৎ সাম্রাজ্য স্থাপন এই যুদ্ধের উদ্দেশ্য ৷ সমস্ত সুখকে জলাঞ্জলি দিয়া জীবনব্যাপী দুঃখ ও যন্ত্রণা সহ্য করিয়াও এই উদ্দেশ্যসিদ্ধি অর্জুনের কর্তব্য ৷
কুলনাশের কথা
কিন্তু স্বীয় দুর্বলতার সমর্থনে অর্জুন আর এক উচ্চতর যুক্তি আবিষ্কার করিলেন, এই যুদ্ধে কুলনাশ ও জাতিনাশ হইবে, অতএব এই যুদ্ধ ধৰ্ম্মযুদ্ধ নহে, অধৰ্ম্মযুদ্ধ ৷ এই ভ্রাতৃহত্যায় মিত্রদ্রোহ, অর্থাৎ যাঁহারা স্বভাবতঃ অনুকূল ও সহায়, তাঁহাদের অনিষ্ট করা হয়, উপরন্তু স্বীয় কুল অর্থাৎ যে কুরুনামক ক্ষত্রিয় বংশ ও জাতিতে উভয় পক্ষের জন্ম হইয়াছে, তাহার বিনাশ সাধিত হয় ৷ প্রাচীন কালে জাতি প্রায়ই রক্তের সম্বন্ধের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল ৷ এক মহান্ কুল বিস্তার পাইয়া জাতিতে পরিণত হইত, যেমন ভােজবংশ, কুরুবংশ ইত্যাদি ভারত-জাতির অন্তর্গত কুলবিশেষ এক-একটী বলশালী জাতি হইয়াছিল ৷ কুলের মধ্যে যে অন্তর্বিরােধ ও পরস্পরের অনিষ্টকরণ তাহাকেই অর্জুন মিত্রদ্রোহ নামে অভিহিত করিলেন ৷ একে এই মিত্রদ্রোহ নৈতিক হিসাবে মহাপাপ, তাহাতে অর্থনীতিক হিসাবে এই মহান্ দোষ মিত্রদ্রোহে সন্নিবিষ্ট যে কুলক্ষয় তাহার অবশ্যম্ভাবী ফল ৷ সনাতন কুলধৰ্ম্মের সম্যক্ পালন কুলের উন্নতির ও অবস্থিতির কারণ, যে মহৎ আদর্শ ও কর্মশৃঙ্খলা গার্হস্থ্যজীবনে ও রাজনীতিক ক্ষেত্রে পিতৃপুরুষগণ স্থাপিত ও রক্ষিত করিয়া আসিতেছেন, সেই আদর্শের হানি বা শৃঙ্খলার শিথিলীকরণ হইলে কুলের অধঃপতন হয় ৷ কুল যতদিন সৌভাগ্যবান ও বলশালী হইয়া থাকে, ততদিন এই আদর্শ ও কর্মশৃঙ্খলা রক্ষিত হয়, কুল ক্ষীণ ও দুৰ্বল হইয়া পড়িলে তমােভাবের প্রসারণে মহান্ ধৰ্ম্মে শিথিলতা হয়, তাহার ফলে অরাজকতা, দুর্নীতি ইত্যাদি দোষ কুলে প্রবিষ্ট হয়, কুলের মহিলাগণ দুশ্চরিত্রা হয় এবং কুলের পবিত্রতা নষ্ট হয়, নীচজাতীয় ও নীচচরিত্রবিশিষ্ট লােকের ঔরসে মহান কুলে পুত্রোৎপাদন হয় ৷ তাহাতে পিতৃপুরুষের প্রকৃত সন্ততিচ্ছেদে কুলহন্তাদের নরক-প্রাপ্তি হয় এবং অধর্মের প্রসারে, বর্ণসঙ্করসস্তৃত নৈতিক অধােগতি ও নীচ গুণের বিস্তারে এবং অরাজকতা প্রভৃতি দোষে সমস্ত কুলও বিনাশপ্রাপ্ত হয় এবং নরকপ্রাপ্তির যােগ্য হয় ৷ জাতিধৰ্ম্ম ও কুলধৰ্ম্ম উভয়ই কুলনাশে নষ্ট হয় ৷ জাতিধর্ম অর্থাৎ সমস্ত কুলসমষ্টিতে যে মহান্ জাতি হয়, সেই জাতির পুরুষপরম্পরায় আগত সনাতন আদর্শ ও কর্মশৃঙ্খলা ৷ তাহার পরে অর্জুন আবার তাহার প্রথম সিদ্ধান্ত ও কর্তব্য-কৰ্ম্মবিষয়ক নিশ্চয় জ্ঞাপন করিয়া যুদ্ধের সময়েই গাণ্ডীব পরিত্যাগ করিয়া রথে বসিয়া পড়িলেন ৷ কবি এই অধ্যায়ের শেষ শ্লোকে ইঙ্গিত করিয়া জানাইলেন যে, শােকে তঁাহার বুদ্ধিবিভ্রাট হইয়াছিল বলিয়া অৰ্জ্জুন এইরূপ ক্ষত্রিয়ের অনুচিত অনাৰ্য্য আচরণে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছিলেন ৷
বিদ্যা ও অবিদ্যা
আমরা অর্জুনের কুলনাশবিষয়ক কথার মধ্যে একটী অতি বৃহৎ ও উন্নত ভাবের ছায়া দেখিতে পাই, এই ভাবের সহিত যে গুরুতর প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট, তাহার আলােচনা গীতার ব্যাখ্যাকার পক্ষে অতিশয় প্রয়ােজনীয় ৷ অথচ আমরা যদি কেবল গীতার আধ্যাত্মিক অর্থ অন্বেষণ করি, আমাদের জাতীয়, গার্হস্থ্য ও ব্যক্তিগত সাংসারিক কৰ্ম্ম ও আদর্শ হইতে গীতােক্ত ধৰ্ম্মের সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ করি, সেই ভাব ও সেই প্রশ্নের মহত্ত্ব ও প্রয়ােজনীয়তা অস্বীকার করিব এবং গীতােক্ত ধৰ্ম্মের সর্বব্যাপী বিস্তার সঙ্কুচিত করিব ৷ শঙ্কর প্রভৃতি যাঁহারা গীতার ব্যাখ্যা করিয়াছেন, তাহারা সংসারপঙ্খ দার্শনিক অধ্যাত্মবিদ্যাপরায়ণ জ্ঞানী বা ভক্ত ছিলেন, গীতায় তাহাদের প্রয়ােজনীয় জ্ঞান বা ভাব খুঁজিয়া যাহা প্রয়ােজনীয়, তাহাই লাভ করিয়া সন্তুষ্ট হইলেন ৷ যাঁহারা এক আধারে জ্ঞানী, ভক্ত ও কর্মী তাহারাই গীতার গুঢ়তম শিক্ষার অধিকারী ৷ গীতার বক্তা শ্রীকৃষ্ণ জ্ঞানী ও কর্মী ছিলেন, গীতার পাত্র অর্জুন ভক্ত ও কর্মী ছিলেন, তাঁহার জ্ঞানচক্ষু উন্মীলনের জন্য কুরুক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ এই শিক্ষা প্রচার করিলেন ৷ একটী মহৎ রাজনীতিক সংঘর্ষ গীতাপ্রচারের কারণ, সেই সংঘর্ষে অর্জনকে মহৎ রাজনীতিক উদ্দেশ্যসিদ্ধির যন্ত্র ও নিমিত্তরূপে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করা গীতার উদ্দেশ্য, যুদ্ধক্ষেত্রই শিক্ষাস্থল ৷ শ্রীকৃষ্ণ শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ও যােদ্ধা, ধৰ্ম্মরাজ্য সংস্থাপন তাহার জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য, অর্জুনও ক্ষত্রিয় রাজকুমার, রাজনীতি ও যুদ্ধ তাঁহার স্বভাবনিয়ত কৰ্ম্ম ৷ গীতার উদ্দেশ্য বাদ দিয়া, গীতার বক্তা, পাত্র ও প্রচারের কারণ বাদ দিয়া গীতার ব্যাখ্যা করা চলিবে কেন?
মানব-সংসারের পাঁচটী মুখ্য প্রতিষ্ঠা চিরকাল বৰ্ত্তমান – ব্যক্তি, পরিবার, বংশ, জাতি, মানবসমষ্টি ৷ এই পাঁচটী প্রতিষ্ঠার উপর ধর্মও প্রতিষ্ঠিত ৷ ধৰ্ম্মের উদ্দেশ্য ভগবৎপ্রাপ্তি ৷ ভগবৎপ্রাপ্তির দুই মার্গ, বিদ্যাকে আয়ত্ত করা এবং অবিদ্যাকে আয়ত্ত করা, দুটীতেই আত্মজ্ঞান ও ভগবদ্দর্শন উপায় ৷ বিদ্যার মার্গ ব্রহ্মের অভিব্যক্তি অবিদ্যাময় প্রপঞ্চ পরিত্যাগ করিয়া সচ্চিদানন্দ লাভ বা পরব্রহ্মে লয় ৷ অবিদ্যার মার্গ সৰ্ব্বত্র আত্মা ও ভগবানকে দর্শন করিয়া জ্ঞানময় মঙ্গলময় শক্তিময় পরমেশ্বরকে বন্ধু, প্রভু, গুরু, পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা, দাস, প্রেমিক, পতি, পত্নীরূপে প্রাপ্ত হওয়া ৷ শান্তি বিদ্যার উদ্দেশ্য, প্রেম অবিদ্যার উদ্দেশ্য ৷ কিন্তু ভগবানের প্রকৃতি বিদ্যাবিদ্যাময়ী ৷ আমরা যদি কেবল বিদ্যার মার্গ অনুসরণ করি বিদ্যাময় ব্রহ্ম লাভ করিব, যদি কেবল অবিদ্যার মার্গ অনুসরণ করি অবিদ্যাময় ব্রহ্ম লাভ করিব ৷ বিদ্যা ও অবিদ্যা দুইটীকেই যিনি আয়ত্ত করিতে পারেন, তিনিই সম্পূর্ণভাবে বাসুদেবকে লাভ করেন ৷ তিনি বিদ্যা ও অবিদ্যার অতীত ৷ যাঁহারা বিদ্যার শেষ লক্ষ্য পৰ্য্যন্ত পৌঁছিয়াছেন, তাহারা বিদ্যার সাহায্যে অবিদ্যাকে আয়ত্ত করিয়াছেন ৷ ঈশা উপনিষদে এই মহান সত্য অতি স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হইয়াছে, যথা –
অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যে বিদ্যামুপাসতে ৷ ততাে ভূয় ইব তে তমাে য উ বিদ্যায়াং রতাঃ ॥ অন্যদেবাহুৰ্বিদয়াইন্যদাহুরবিদ্য ৷ ইতি শুশ্রম ধীরাণাং যে নস্তদ্বিচ্চক্ষিরে ॥ বিদ্যাঞ্চাবিদ্যাঞ্চ যস্তদ্বেদোভয়ং সহ ৷ অবিদ্যয়া মৃত্যুং তীৰ্ধা বিদ্যমামৃতমতে ॥
“যাঁহারা অবিদ্যার উপাসক হন, তঁহারা অন্ধ অজ্ঞানরূপ তমঃ মধ্যে প্রবেশ করেন ৷1 যে ধীর জ্ঞানীগণ আমাদিগের নিকট ব্রহ্মজ্ঞান প্রচার করিয়াছেন, তাঁহাদের মুখে শুনিয়াছি যে বিদ্যারও ফল আছে, অবিদ্যারও ফল আছে, সেই দুই ফল স্বতন্ত্র ৷ যিনি বিদ্যা ও অবিদ্যা উভয়ই জ্ঞানে আয়ত্ত করিতে পারিয়াছেন, তিনিই অবিদ্যা দ্বারা মৃত্যুকে অতিক্রম করিয়া বিদ্যা দ্বারা অমৃতময় পুরুষােত্তমের আনন্দ ভােগ করেন ৷”
সমস্ত মানবজাতি অবিদ্যা ভােগ করিয়া বিদ্যার দিকে অগ্রসর হইতেছেন, ইহাই প্রকৃত ক্রমবিকাশ ৷ যাঁহারা শ্রেষ্ঠ, সাধক, যােগী, জ্ঞানী, ভক্ত, কর্মযােগী, তাঁহারা এই মহৎ অভিযানের অগ্রগামী সৈন্য, দূর গন্তব্যস্থানে ক্ষিপ্রগতিতে পৌঁছিয়া ফিরিয়া আসেন ও মানবজাতিকে সুসংবাদ শ্রবণ করান, পথ প্রদর্শন করেন, শক্তি বিতরণ করেন ৷ ভগবানের অবতার ও বিভূতি আসিয়া পথ সুগম করেন, অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করেন, বাধা বিনাশ করেন ৷ অবিদ্যায় বিদ্যা, ভােগে ত্যাগ, সংসারে সন্ন্যাস, আত্মার মধ্যে সর্বভূত, সৰ্ব্বভূতের মধ্যে আত্মা, ভগবানে জগৎ, জগতে ভগবান, এই উপলব্ধি আসল জ্ঞান, ইহাই মানবজাতির গন্তব্যস্থানে গমনের নির্দিষ্ট পথ ৷ আত্মজ্ঞানের সঙ্কীর্ণতা উন্নতির প্রধান অন্তরায়, দেহাত্মকবােধ, স্বার্থবােধ, সেই সঙ্কীর্ণতার মূল কারণ, অতএব পরকে আত্মবৎ দেখা উন্নতির প্রথম সােপান ৷ মনুষ্য প্রথম ব্যক্তি লইয়া থাকে, নিজ ব্যক্তিগত শারীরিক ও মানসিক উন্নতি, ভােগ ও শক্তিবিকাশে রত থাকে ৷ আমি দেহ, আমি মন, আমি প্রাণ, দেহের বল, সুখ, সৌন্দৰ্য্য, মনের ক্ষিপ্রতা, আনন্দ, স্বচ্ছতা, প্রাণের তেজ, ভােগ, প্রফুল্লতা জীবনের উদ্দেশ্য ও উন্নতির চরমাবস্থা, মনুষ্যের এই প্রথম বা আসুরিক জ্ঞান ৷ ইহারও প্রয়ােজন আছে; দেহ, মন, প্রাণের বিকাশ ও পরিপূর্ণতা প্রথম সাধন করিয়া তাহার পর সেই পূর্ণবিকশিত শক্তি পরের সেবায় প্রয়ােগ করা উচিত ৷ সেইজন্য আসুরিক শক্তিবিকাশ মানবজাতির সভ্যতার প্রথম অবস্থা; পশু, যক্ষ, রাক্ষস, অসুর, পিশাচ পৰ্য্যন্ত মনুষ্যের মনে, কর্মে, চরিত্রে লীলা করে, বিকাশ পায় ৷ তাহার পর মনুষ্য আত্মজ্ঞান বিস্তার করিয়া পরকে আত্মবৎ দেখিতে আরম্ভ করে, পরার্থে স্বার্থ ডুবাইতে শিখে ৷ প্রথম পরিবারকেই আত্মবৎ দেখে, স্ত্রী-সন্তানের প্রাণরক্ষার জন্য প্রাণত্যাগ করে, স্ত্রী-সন্তানের সুখের জন্য নিজ সুখকে জলাঞ্জলি দেয় ৷ তাহার পরে বংশ বা কুলকে আত্মবৎ দেখে, কুরক্ষার জন্য প্রাণত্যাগ করে, নিজেকে, স্ত্রী-সন্তানকে বলি দেয়, কুলের সুখ, গৌরব ও বৃদ্ধির জন্য নিজের ও স্ত্রী-সন্তানের সুখকে জলাঞ্জলি দেয় ৷ তাহার পরে জাতিকে আত্মবৎ দেখে, জাতিরক্ষার জন্য প্রাণত্যাগ করে, নিজেকে, স্ত্রী-সন্তানকে, কুলকে বলি দেয়, —যেমন চিতােরের রাজপুতকুল সমস্ত রাজপুতজাতির রক্ষার্থে বার বার স্বেচ্ছায় বলি হইল, – জাতির সুখ, গৌরব, বৃদ্ধির জন্য নিজের, স্ত্রী-সন্তানদের, কুলের সুখ, গৌরব, বৃদ্ধিকে জলাঞ্জলি দেয় ৷ তাহার পরে সমস্ত মানবজাতিকে আত্মবৎ দেখে, মানবজাতির উন্নতির জন্য প্রাণত্যাগ করে, নিজেকে, স্ত্রী-সন্তানকে, কুলকে, জাতিকে বলি দেয়, – মানবজাতির সুখ ও উন্নতির জন্য নিজের, স্ত্রী-সন্তানদের, কুলের, জাতির সুখ, গৌরব ও বৃদ্ধিকে জলাঞ্জলি দেয় ৷ এইরূপ পরকে আত্মবৎ দেখা, পরের জন্য নিজেকে ও নিজের সুখকে বলি দেওয়া বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধধৰ্ম্মপ্রসূত খ্রীষ্টধর্মের প্রধান শিক্ষা ৷ য়ুরােপের নৈতিক উন্নতি এই পথে অগ্রসর হইয়াছে ৷ প্রাচীন য়ুরােপীয়গণ ব্যক্তিকে পরিবারে ডুবাইতে, পরিবারকে কুলে ডুবাইতে শিখিয়াছিলেন, আধুনিক য়ুরােপীয়গণ কুলকে জাতিতে ডুবাইতে শিখিয়াছেন, জাতিকে মানবসমষ্টিতে ডুবান এখন তাহাদের মধ্যে কঠিন আদর্শ বলিয়া প্রচারিত; টলষ্টয় ইত্যাদি মনীষীগণ এবং সােশ্যালিষ্ট, এনার্কিষ্ট ইত্যাদি নব আদর্শের অনুমােদক দল এই আদর্শ কার্যে পরিণত করিবার জন্য উৎসুক হইয়াছেন ৷ এই পৰ্য্যন্ত য়ুরােপের দৌড় ৷ তাহারা অবিদ্যার উপাসক, প্রকৃত বিদ্যা অবগত নহেন ৷ অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যে বিদ্যামুপাসতে ৷
ভারতে বিদ্যা ও অবিদ্যা উভয়ই মনীষীগণ আয়ত্ত করিয়াছেন ৷ তাহারা জানেন অবিদ্যার পঞ্চপ্রতিষ্ঠা ভিন্ন বিদ্যার প্রতিষ্ঠা ভগবান আছেন, তাহাকে না জানিতে পারিলে অবিদ্যাও জ্ঞাত হয় না, আয়ত্ত হয় না ৷ অতএব কেবল পরকে আত্মবৎ না দেখিয়া আত্মবৎ পরদেহেষু অর্থাৎ নিজের মধ্যে ও পরের মধ্যে সমানভাবে ভগবানকে দর্শন করিয়াছেন ৷ নিজের উৎকর্ষ করিব, নিজের উৎকর্ষে পরিবারের উৎকর্ষ সাধিত হইবে; পরিবারের উৎকর্ষ করিব, পরিবারের উৎকর্ষে কুলের উৎকর্ষ সাধিত হইবে; জাতির উৎকর্ষ করিব, জাতির উৎকর্ষে মানবজাতির উৎকর্ষ সাধিত হইবে; এই জ্ঞান আৰ্য সামাজিক ব্যবস্থার ও আৰ্য শিক্ষার মূলে নিহিত ৷ ব্যক্তিগত ত্যাগ আৰ্য্যের মজ্জাগত অভ্যাস, পরিবারের জন্য ত্যাগ, কলের জন্য ত্যাগ, সমাজের জন্য ত্যাগ, মানবজাতির জন্য ত্যাগ, ভগবানের জন্য ত্যাগ ৷ আমাদের শিক্ষায় যে দোষ বা ন্যূনতা লক্ষিত হয়, সেই দোষ কয়েকটী ঐতিহাসিক কারণের ফল, যেমন, জাতিকে সমাজের মধ্যে দেখি, সমাজের হিতে ব্যক্তির ও পরিবারের হিত ডুবাইয়া থাকি, কিন্তু জাতির রাজনীতিক জীবনবিকাশ আমাদের ধর্মের অন্তর্গত মুখ্য অঙ্গ বলিয়া গৃহীত ছিল না ৷ পাশ্চাত্য হইতে এই শিক্ষা আমদানী করিতে হইল ৷ অথচ আমাদেরও প্রাচীন শিক্ষার মধ্যে, মহাভারতে, গীতায়, রাজপুতানার ইতিহাসে, রামদাসের দাসবােধে এই শিক্ষা আমাদের স্বদেশেই ছিল ৷ অতিরিক্ত বিদ্যা-উপাসনায়, অবিদ্যাভয়ে আমরা সেই শিক্ষা বিকাশ করিতে পারি নাই, সেই দোষে তমাভিভূত হইয়া জাতিধৰ্ম্ম হইতে চ্যুত হইয়া কঠিন দাসত্বে, দুঃখে, অজ্ঞানে পড়িলাম, অবিদ্যাও আয়ত্ত করিতে পারি নাই, বিদ্যাও হারাইতে বসিয়াছিলাম ৷ ততাে ভূয় ইবতে তমাে য উ বিদ্যায়াং রতাঃ ৷
শ্রীকৃষ্ণের রাজনীতিক উদ্দেশ্য
কুল ও জাতি মানবসমাজের ক্রমিক বিকাশে ভিন্ন হয়, প্রাচীনকালে সেই ভিন্নতা ভারতে ও অন্য দেশেও এত পরিস্ফুট হয় নাই ৷ কয়েকটী বড় বড় কুলের সমাবেশে একটী জাতি হইয়া দাঁড়াইত ৷ এই ভিন্ন ভিন্ন কুল হয় এক পূর্বপুরুষের বংশধর, নয় ভিন্ন-বংশজাত হইলেও প্রীতিসংস্থাপনে এক বংশজাত বলিয়া গৃহীত ৷ সমস্ত ভারত এক বড় জাতি হয় নাই, কিন্তু যে বড় বড় জাতি সমস্ত দেশ ছাইয়া বিরাজ করিত, তাহাদের মধ্যে এক সভ্যতা, এক ধৰ্ম্ম, এক সংস্কৃত ভাষা এবং বিবাহ ইত্যাদি সম্বন্ধ প্রচলিত ছিল ৷ তথাপি প্রাচীনকাল হইতে একত্বের চেষ্টা হইয়া আসিয়াছিল, কখনও কুরু, কখনও পাঞ্চাল, কখনও কোশল, কখনও মগধ জাতি দেশের নেতা বা সার্বভৌম রাজা হইয়া সাম্রাজ্য করিত, কিন্তু প্রাচীন কুলধৰ্ম্ম ও কুলের স্বাধীনতাপ্রিয়তা একত্বের এমন প্রবল অন্তরায় সৃষ্টি করিত যে সেই চেষ্টা কখন চিরকাল টিকিতে পারে নাই ৷ ভারতে এই একত্বের চেষ্টা, অসপত্ন সাম্রাজ্যের চেষ্টা পুণ্যকর্ম এবং রাজার কর্তব্যকর্মের মধ্যে গণ্য ছিল ৷ এই একত্বের স্রোত এত প্রবল হইয়াছিল যে চেদিরাজ শিশুপালের ন্যায় তেজস্বী ও দুরন্ত ক্ষত্রিয়ও যুধিষ্ঠিরের সাম্রাজ্যস্থাপনে পুণ্যকৰ্ম্ম বলিয়া যােগদান করিতে সম্মত হইয়াছিলেন ৷ এইরূপ একত্ব, সাম্রাজ্য বা ধৰ্ম্মরাজ্য সংস্থাপন শ্রীকৃষ্ণের রাজনীতিক উদ্দেশ্য ৷ মগধরাজ জরাসন্ধ পূৰ্বেই এই চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু তাহার শক্তি অধৰ্ম্ম ও অত্যাচারের উপর প্রতিষ্ঠিত, অতএব ক্ষণস্থায়ী বলিয়া শ্রীকৃষ্ণ তাহাকে ভীমের হাতে বধ করাইয়া সেই চেষ্টা বিফল করিলেন ৷ শ্রীকৃষ্ণের কাৰ্য্যের প্রধান বাধা গর্বিত ও তেজস্বী কুরুবংশ ৷ কুজাতি অনেকদিন হইতে ভারতের নেতৃস্থানীয় জাতি ছিল, ইংরাজিতে যাহাকে hegemony বলে অর্থাৎ অনেক সমান স্বাধীন জাতির মধ্যে প্রধানত্ব ও নেতৃত্ব, তাহাতে কুরুজাতির পুরুষপরম্পরাগত অধিকার ছিল ৷ যতদিন এই জাতির বল ও গর্ব অক্ষুন্নভাবে থাকিবে, ভারতে কখন একত্ব স্থাপিত হইবে না, শ্রীকৃষ্ণ ইহা বুঝিতে পারিলেন ৷ অতএব তিনি কুরুজাতির ধ্বংস করিতে কৃতসঙ্কল্প হইলেন ৷ কিন্তু ভারতের সাম্রাজ্যে কুরজাতির পুরুষপরম্পরাগত অধিকার ছিল, শ্রীকৃষ্ণ এই কথা বিস্মৃত হন নাই; যাহা ধৰ্ম্মতঃ কাহারও প্রাপ্য, তাহাতে তাহাকে বঞ্চিত করা অধৰ্ম্ম বলিয়া কুরুজাতির যে ন্যায়তঃ রাজা ও প্রধান, সেই যুধিষ্ঠিরকে ভাবী সম্রাটপদে নিযুক্ত করিবার জন্য মনােনীত করিলেন ৷ শ্রীকৃষ্ণ পরম ধাৰ্ম্মিক, সমর্থ হইয়াও স্নেহের বশে নিজের প্রিয় যাদবকুলকে কুরুজাতির স্থানে স্থাপন করিবার চেষ্টা করেন নাই, পাণ্ডবদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরকে অবহেলা করিয়া নিজ প্রিয়তম সখা অৰ্জ্জুনকে সেই পদে নিযুক্ত করেন নাই ৷ কিন্তু কেবল বয়স বা পূর্ব অধিকার দেখিলে অনিষ্টের সম্ভাবনা হয়, গুণ ও সামর্থ্যও দেখিতে হয় ৷ রাজা যুধিষ্ঠির যদি অধাৰ্ম্মিক, অত্যাচারী বা অশক্ত হইতেন, তাহা হইলে শ্রীকৃষ্ণ অন্য পাত্রকে অন্বেষণ করিতে বাধ্য হইতেন ৷ যুধিষ্ঠির যেমন বংশক্রমে, ন্যায্য অধিকারে ও দেশের পূর্বপ্রচলিত নিয়মে সম্রাট হইবার উপযুক্ত, তেমনই গুণেও সেই পদের প্রকৃত অধিকারী ছিলেন ৷ তাঁহা অপেক্ষা তেজস্বী ও প্রতিভাবান অনেক বড় বড় বীর নৃপতি ছিলেন, কিন্তু কেবল বলে ও প্রতিভায় কেহ রাজ্যের অধিকারী হন না ৷ রাজা ধৰ্ম্মরক্ষা করিবেন, প্রজারঞ্জন করিবেন, দেশরক্ষা করিবেন ৷ প্রথম দুই গুণে যুধিষ্ঠির অতুলনীয় ছিলেন, তিনি ধৰ্ম্মপুত্র, তিনি দয়াবান, ন্যায়পরায়ণ, সত্যবাদী, সত্যপ্রতিজ্ঞ, সত্যকৰ্ম্মা, প্রজার অতীব প্রিয় ৷ শেষােক্ত আবশ্যক গুণে তাহার যে ন্যূনতা ছিল, তাহার বীর ভ্রাতৃদ্বয় ভীম ও অর্জুন তাহা পূরণ করিতে সমর্থ ছিলেন ৷ পঞ্চপাণ্ডবের তুল্য পরাক্রমী রাজা বা বীরপুরুষ সমকালীন ভারতে ছিলেন না ৷ অতএব জরাসন্ধবধে কণ্টক উদ্ধার করিয়া শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শে রাজা যুধিষ্ঠির দেশের প্রাচীন প্রণালী অনুসরণ করিয়া রাজসূয় যজ্ঞ করিলেন এবং দেশের সম্রাট হইলেন ৷
শ্রীকৃষ্ণ ধার্মিক ও রাজনীতিবিদ ৷ দেশের ধর্ম, দেশের প্রণালী, দেশের সামাজিক নিয়মের ভিতরে কৰ্ম্ম করিয়া যদি তাঁহার মহৎ উদ্দেশ্য সুসিদ্ধ হইবার সম্ভাবনা থাকে, তবে সেই ধৰ্ম্মের হানি, সেই প্রণালীর বিরুদ্ধাচরণ, সেই নিয়ম ভঙ্গ করিবেন কেন? বিনা কারণে এইরূপ রাষ্ট্রবিপ্লব ও সমাজবিপ্লব করা দেশের অহিতকর হয় ৷ সেই হেত প্রথমে পরাতন প্রণালী রক্ষা করিয়া উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য সচেষ্ট হইলেন ৷ কিন্তু দেশের প্রাচীন প্রাণালীর এই দোষ ছিল যে তাহাতে চেষ্টা সফল হইলেও সে ফল স্থায়ী হইবার অতি অল্প সম্ভাবনা ছিল ৷ যাঁহার সামরিক বলবৃদ্ধি আছে, তিনি রাজসূয় যজ্ঞ করিয়া সম্রাট হইতে পারেন বটে, কিন্তু তাঁহার বংশধর ক্ষীণতেজ হইবামাত্র সেই মুকুট মস্তক হইতে আপনি খসিয়া পড়ে ৷ যে তেজস্বী বীরজাতিসকল তাঁহার পিতার বা পিতামহের বশ হইয়াছিলেন, তাহারা বিজয়ী পুত্রের বা পৌত্রের অধীনতা স্বীকার করিবেন কেন? বংশগত অধিকার নহে, রাজসূয় যজ্ঞই অর্থাৎ অসাধারণ বলবীৰ্য্য সেই সাম্রাজ্যের মূল, যাঁহার অধিক বলবীৰ্য্য তিনিই যজ্ঞ করিয়া সম্রাট হইবেন ৷ অতএব সাম্রাজ্যের কোন স্থায়িত্ব হইবার আশা ছিল না, অল্পকাল প্রধানত্ব বা hegemonyই হইতে পারে ৷ এই প্রথার আর একটী দোষ এই ছিল যে, নবসম্রাটের অকস্মাৎ বলবৃদ্ধি ও প্রধানত্বলাভে দেশের বলদৃপ্ত অসহিষ্ণু তেজস্বী ক্ষত্রিয়গণের হৃদয়ে ঈৰ্য্যাবহ্নি প্রজ্বলিত হয়; ইনি প্রধান হইবেন কেন, আমরা কেন হইব না, এই বিচার সহজে মনের মধ্যে উঠিবার সম্ভাবনা ছিল ৷ যুধিষ্ঠিরের নিজকুলের ক্ষত্রিয়গণ এই ঈর্ষায় তাহার বিরুদ্ধাচারী হইলেন, তাঁহার পিতৃব্যের সন্তানগণ এই ঈৰ্য্যার উপর নির্ভর করিয়া কৌশলে তাহাকে পদচ্যুত ও নির্বাসিত করিলেন ৷ দেশের প্রণালীর দোষ অল্পদিনেই ব্যক্ত হইল ৷
শ্রীকৃষ্ণ যেমন ধাৰ্ম্মিক তেমনই রাজনীতিবিদ ৷ তিনি কখনও সদোষ, অহিতকর বা সময়ের অনুপযােগী প্রণালী, উপায় বা নিয়ম বদলাইতে পশ্চাৎপদ হইতেন না ৷ তিনি তাহার যুগের প্রধান বিপ্লবকারী ৷ রাজা ভূরিশ্রবা শ্রীকৃষ্ণকে ভৎসনা করিবার সময় সমকালীন পুরাতন মতের অনেক ভারতবাসীর আক্রোশ ব্যক্ত করিয়া বলিলেন, কৃষ্ণ ও কৃষ্ণচালিত যাদবকুল কখনও ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করিতে বা ধৰ্ম্মকে বিকৃত করিতে কুণ্ঠিত হন না, যে কৃষ্ণের পরামর্শে কাৰ্য্য করিবে, সেই নিশ্চয় অবিলম্বে পাপে পতিত হইবে ৷ কেন না, পুরা রীতিতে আসক্ত রক্ষণশীলের মতে নূতন প্রয়াসই পাপ ৷ শ্রীকৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের পতনে বুঝিলেন – বুঝিলেন কেন, তিনি ভগবান, পূর্বে জানিতেন, – যে, দ্বাপরযুগের উপযােগী প্রথা কলিতে কখনও রক্ষণীয় নহে ৷ অতএব তিনি আর সেইরূপ চেষ্টা করিলেন না, কলির উচিত ভেদদণ্ড প্রধান রাজনীতি অনুসরণ করিয়া গতি দৃপ্ত ক্ষত্রিয় জাতির বল নাশে ভাবী সাম্রাজ্যকে নিষ্কণ্টক করিতে সচেষ্ট হইলেন ৷ তিনি কুরুদের পুরাতন সমকক্ষ শত্রু পাঞ্চালজাতিকে কুরুধ্বংসে প্রবৃত্ত করিলেন, যত জাতি কুরুদের বিদ্বেষে যুধিষ্ঠিরের প্রেমে বা ধৰ্ম্মরাজ্য ও একত্বের আকাঙ্ক্ষায় আকৃষ্ট হইতে পারে, সকলকে সেই পক্ষে আকর্ষণ করিলেন এবং যুদ্ধের উদ্যোগ করাইলেন ৷ যে সন্ধির চেষ্টা হইল, তাহাতে শ্রীকৃষ্ণের আস্থা ছিল না, তিনি জানিতেন সন্ধির সম্ভাবনা নাই, সন্ধি স্থাপিত হইলেও সে স্থায়ী হইতে পারে না, তথাপি ধৰ্ম্মের খাতিরে ও রাজনীতির খাতিরে তিনি সন্ধির চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইলেন ৷ সন্দেহ নাই, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শ্রীকৃষ্ণের রাজনীতির ফল, কুরুধ্বংস, ক্ষত্রিয়ধ্বংস ও নিষ্কণ্টক সাম্রাজ্য ও ভারতের একত্বস্থাপন তাহার উদ্দেশ্য ৷ ধৰ্ম্মরাজ্য স্থাপনের জন্য যে যুদ্ধ, সেই ধৰ্ম্মযুদ্ধ, সেই ধৰ্ম্মযুদ্ধের ঈশ্বরনির্দিষ্ট বিজেতা, দিব্যশক্তিপ্রণােদিত মহারথী অৰ্জ্জুন ৷ অর্জুন শস্ত্রত্যাগ করিলে, শ্রীকৃষ্ণের রাজনীতিক পরিশ্রম পণ্ড হইত, ভারতের একত্বও সাধিত হইত না, দেশের ভবিষ্যতে অবিলম্বে ঘাের কুফল ফলিত ৷
ভ্রাতৃবধ ও কুলনাশ
অর্জুনের সমস্ত যুক্তি কুলের হিত অপেক্ষা করিয়া প্রয়ােজিত, জাতির হিতচিন্তা স্নেহবশে তাঁহার মন হইতে অপসারিত হইয়াছে ৷ তিনি কুরুবংশের হিত ভাবিয়া ভারতের হিত বিস্মৃত হইয়াছেন, অধৰ্ম্মের ভয়ে ধৰ্ম্মকে জলাঞ্জলি দিতে বদ্ধ-পরিকর হইতেছেন ৷ স্বার্থের জন্য ভ্রাতৃবধ মহাপাপ, এ কথা সকলে জানে, কিন্তু ভ্রাতৃপ্রেমের বশে জাতীয় অনর্থ সম্পাদনে সহায় হওয়া, জাতীয় হিতসাধনে বিমুখ হওয়া, এই পাপ গুরুতর ৷ অর্জুন যদি শস্ত্রত্যাগ করেন, অধর্মের জয় হইবে, দুৰ্য্যোধন ভারতে প্রধান নৃপতি ও সমস্ত দেশের নেতা হইয়া জাতীয় চরিত্র ও ক্ষত্রিয়কুলের আচরণ স্বীয় কুদৃষ্টান্তে কলুষিত করিবেন, ভারতের প্রবল পরাক্রান্ত কুলসকল স্বার্থ, ঈর্ষা ও বিরােধপ্রিয়তার প্রেরণায় পরস্পরকে বিনাশ করিতে উদ্যত হইবে, দেশকে একত্রিত, নিয়ন্ত্রিত ও শক্তির সমাবেশে সুরক্ষিত করিবার কোন অসপত্ন ধৰ্ম্ম-প্রণােদিত রাজশক্তি থাকিবে না, এই অবস্থায় যে বিদেশী আক্রমণ তখনও রুদ্ধ সমুদ্রের ন্যায় ভারতের উপর পড়িয়া প্লাবিত করিতে প্রস্তুত হইতেছিল, সে অসময়ে আসিয়া আৰ্যসভ্যতা ধ্বংস করিয়া জগতে ভাবী হিতের আশা নির্মূল করিত ৷ শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যের নাশে দুই সহস্র বর্ষ পরে ভারতে যে রাজনীতিক উৎপাত আরম্ভ হইয়াছিল, তাহা তখনই আরম্ভ হইত ৷
লােকে বলে অর্জন যে অনিষ্টের ভয়ে এই আপত্তি করিয়াছিলেন, সত্য সত্য ৷ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ফলে সেই অনিষ্ট ফলিল ৷ ভ্রাতৃবধ, কুলনাশ, জাতিনাশ পৰ্য্যন্ত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ফল ৷ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ কলি প্রবর্তিত হইবার কারণ ৷ এই যুদ্ধে ভীষণ ভ্রাতৃবধ হইল, ইহা সত্য ৷ জিজ্ঞাস্য এই, আর কি উপায়ে শ্রীকৃষ্ণের মহৎ উদ্দেশ্য সাধিত হইত? এইজন্যই শ্রীকৃষ্ণ সন্ধিপ্রার্থনার বিফলতা জানিয়াও সন্ধিস্থাপনের জন্য বিস্তর চেষ্টা করিয়াছিলেন, এমন কি পঞ্চ গ্রামও ফিরিয়া পাইলে যুধিষ্ঠির যুদ্ধে ক্ষান্ত হইতেন, সেইটুকু পদ রাখিবার স্থল পাইলেও শ্রীকৃষ্ণ ধৰ্ম্মরাজ্য সংস্থাপন করিতে পারিতেন ৷ কিন্তু দুৰ্য্যোধনের দৃঢ়নিশ্চয় ছিল, বিনাযুদ্ধে সূচ্যগ্র ভূমিও দিবেন না ৷ যখন সমস্ত দেশের ভবিষ্যৎ যুদ্ধের ফলের উপর নির্ভর করে, সেই যুদ্ধে ভ্রাতৃবধ হইবে বলিয়া মহৎ কর্মে ক্ষান্ত হওয়ায় অধৰ্ম্ম হয় ৷ পরিবারের হিত জাতির হিতে, জগতের হিতে ডুবাইতে হয়; ভ্রাতৃস্নেহে, পারিবারিক ভালবাসার মােহে কোটী কোটী লােকের সৰ্ব্বনাশ করা চলে না, কোটী কোটী লােকের ভাবী সুখ বা দুঃখমােচন বিনষ্ট করা চলে না, তাহাতে ব্যক্তির ও কুলের নরকপ্রাপ্তি হয় ৷
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কুলনাশ হইয়াছিল, তাহাও সত্য কথা ৷ এই যুদ্ধের ফলে মহাপ্রতাপান্বিত কুরুবংশ একরূপ লােপ পাইল ৷ কিন্তু কুরুজাতির লােপে যদি সমস্ত ভারত রক্ষা পাইয়া থাকে, তাহা হইলে কুরুধ্বংসে ক্ষতি না হইয়া লাভই হইয়াছে ৷ যেমন পারিবারিক ভালবাসার মায়া আছে, তেমনই কুলের উপর মায়া আছে ৷ দেশভাইকে কিছু বলিব না, দেশবাসীর সঙ্গে বিরােধ করিব না, অনিষ্ট করিলেও, আততায়ী হইলেও, দেশের সর্বনাশ করিলেও তিনি ভাই, স্নেহের পাত্র, নীরবে সহ্য করিব, আমাদের মধ্যে যে বৈষ্ণবী মায়া-প্রসূত অধৰ্ম্ম ধৰ্ম্মের ভান করিয়া অনেকের বুদ্ধিভ্রংশ করে, তাহা এই কুলের মায়ার মােহে উৎপন্ন ৷ বিনা কারণে বা স্বার্থের জন্য, নিতান্ত প্রয়ােজন ও আবশ্যকতার অভাবে দেশভাইয়ের সঙ্গে বিরােধ ও কলহ করা অধৰ্ম্ম ৷ কিন্তু যে দেশভাই সকলের মাকে প্রাণে বধ করিতে বা তাহার অনিষ্ট করিতে বদ্ধপরিকর, তাহার দৌরাত্ম নীরবে সহ্য করিয়া সেই মাতৃহত্যা বা অনিষ্টাচরণকে প্রশ্রয় দেওয়া আরও গুরুতর পাতক ৷ শিবাজী যখন মসলমানের পৃষ্ঠপােষক দেশভাইকে সংহার করিতে গেলেন, তখন যদি কেহ বলিতেন, আহা! কি কর, ইহারা দেশভাই, নীরবে সহ্য কর, মােগল মহারাষ্ট্রদেশকে অধিকার করে করুক, মারাঠায় মারাঠায় প্রেম থাকিলেই হয়, – কথাটী কি নিতান্ত হাস্যকর বােধ হইত না? আমেরিকানরা যখন দাসত্বপ্রথা উঠাইবার জন্য দেশে বিরােধসৃষ্টি ও অন্তঃস্থ যুদ্ধসৃষ্টি করিয়া সহস্র সহস্ৰ দেশ-ভাইয়ের প্রাণসংহার করিলেন, তাহারা কি কুকৰ্ম্ম করিয়াছিলেন? এমন হয় যে দেশভাইয়ের সঙ্গে বিরােধ, দেশভাইকে যুদ্ধে বধ, জাতির হিত ও জগতের হিতের একমাত্র উপায় হয় ৷ ইহাতে কুলনাশের আশঙ্কা যদি হয়, তাহা হইলেও জাতির হিত ও জগতের হিতসাধনে ক্ষান্ত হইতে পারি না ৷ অবশ্য যদি সেই কুলের রক্ষা জাতির হিতের জন্য আবশ্যক হয়, সমস্যা জটিল হয় ৷ মহাভারতের যুগে ভারতে জাতি প্রতিষ্ঠিত হয় নাই, সকলে কুলকেই মনুষ্যজাতির কেন্দ্র বলিয়া জানিত ৷ সেইজন্যই ভীষ্ম, দ্রোণ প্রভৃতি যাঁহারা পুরাতন বিদ্যার আকর ছিলেন, পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়াছিলেন ৷ তাঁহারা জানিতেন যে ধৰ্ম্ম পাণ্ডবদের দিকে, জানিতেন যে মহৎ সাম্রাজ্যসংস্থাপনে সমস্ত ভারতকে এক কেন্দ্রে আবদ্ধ করার প্রয়ােজন ছিল ৷ কিন্তু তাহারা ইহাও বুঝিতেন যে কুলই ধৰ্ম্মের প্রতিষ্ঠা ও জাতির কেন্দ্র, কুলনাশে ধৰ্ম্মরক্ষা ও জাতিসংস্থাপন অসম্ভব ৷ অৰ্জ্জুনও সেই ভ্রমে পতিত হইলেন ৷ এই যুগে জাতিই ধৰ্ম্মের প্রতিষ্ঠা, মানবসমাজের কেন্দ্র ৷ জাতিরক্ষা এই যুগের প্রধান ধৰ্ম্ম, জাশি এই যুগের অমার্জনীয় মহাপাতক ৷ কিন্তু এমন যুগ আসিতেও পারে যখন এক বৃহৎ মানবসমাজ প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে, তখন হয়ত জগতের বড় বড় জ্ঞানী ও কর্মী জাতির রক্ষার জন্য যুদ্ধ করিবেন, অপর পক্ষে শ্রীকৃষ্ণ বিপ্লবকারী হইয়া নব কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ বাধাইয়া জগতের হিতসাধন করিবেন ৷
শ্রীকৃষ্ণের রাজনীতির ফল
প্রথম কৃপার আবেশে অর্জুন কুলনাশের উপর অধিক নির্ভর করিয়াছিলেন, কেন না, এই বৃহৎ সৈন্যসমাবেশ দর্শনে কুলের চিন্তা, জাতির চিন্তা আপনিই মনে উঠে ৷ বলা হইয়াছে, কুলের হিতচিন্তা সেইকালের ভারতবাসীর পক্ষে স্বাভাবিক, যেমন জাতির হিতচিন্তা আধুনিক মনুষ্যজাতির পক্ষে স্বাভাবিক ৷ কিন্তু কুলনাশে জাতির প্রতিষ্ঠা নাশ হইবে, এই আশঙ্কা কি অমূলক ছিল? অনেকে বলে, অর্জুন যাহা ভয় করিয়াছিলেন, বাস্তবিক তাহাই ঘটিল, কুরুক্ষেত্ৰযুদ্ধ ভারতের অবনতি ও দীর্ঘকালব্যাপী পরাধীনতার মূল কারণ ৷ তেজস্বী ক্ষত্রিয়বংশের লােপে, ক্ষত্ৰতেজের হাসে ভারতের বিষম অমঙ্গল হইয়াছে ৷ একজন বিখ্যাত বিদেশী মহিলা, যাঁহার শ্রীচরণে অনেক হিন্দু এখন শিষ্যভাবে আনতশির, এই বলিতে কুণ্ঠিত হন নাই যে ক্ষত্রিয়নাশে ইংরাজ-সাম্রাজ্য স্থাপনের পথ সুগম করাই স্বয়ং ভগবান অবতীর্ণ হইবার আসল উদ্দেশ্য ছিল ৷ আমাদের ধারণা, যাঁহারা এইরূপ অসংলগ্ন কথা বলেন, তাঁহারা বিষয়টী না তলাইয়া অতি নগণ্য রাজনীতিক তত্ত্বের বশবর্তী হইয়া শ্রীকৃষ্ণের রাজনীতির দোষ দেখাইতেছেন ৷ এই রাজনীতিক তত্ত্ব ম্লেচ্ছবিদ্যা, অনাৰ্য্য চিন্তাপ্রণালী-সভৃত ৷ অনাৰ্য্যগণ আসুরিক বলে বলীয়ান, সেই বলকে স্বাধীনতা ও জাতীয় মহত্ত্বের একমাত্র ভিত্তি বলিয়া জানেন ৷
জাতীয় মহত্ত্ব কেবল ক্ষত্রতেজের উপর প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে না, চতুৰ্ব্বর্ণের চতুর্বিধ তেজই সেই মহত্ত্বের প্রতিষ্ঠা ৷ সাত্ত্বিক ব্রহ্মতেজ রাজসিক ক্ষত্ৰতেজকে জ্ঞান, বিনয় ও পরহিতচিন্তার মধুর সঞ্জীবনী সুধায় জীবিত করিয়া রাখে, ক্ষত্ৰতেজ শান্ত ব্রহ্মতেজকে রক্ষা করে ৷ ক্ষত্ৰতেজরহিত ব্রহ্মতেজ তমােভাব দ্বারা আক্রান্ত হইয়া শূদ্রত্বের নিকৃষ্ট গুণসকলকে আশ্রয় দেয়, অতএব যে দেশে ক্ষত্রিয় নাই, সেই দেশে ব্রাহ্মণের বাস নিষিদ্ধ ৷ যদি ক্ষত্রিয়বংশের লােপ হয়, নূতন ক্ষত্রিয়কে সৃষ্টি করা ব্রাহ্মণের প্রথম কৰ্ত্তব্য ৷ ব্রহ্মতেজপরিত্যক্ত ক্ষত্ৰতেজ দুর্দান্ত উদ্দাম আসুরিক বলে পরিণত হইয়া প্রথম পরহিত বিনাশ করিতে চেষ্টিত হয়, শেষে স্বয়ং বিনষ্ট হয় ৷ রােমান কবি যথার্থ বলিয়াছেন, অসুরগণ স্বীয় বলাতিরেকে পতিত হইয়া সমূলে বিনষ্ট হয় ৷ সত্ব রজঃকে সৃষ্টি করিবে, রজঃ সত্ত্বকে রক্ষা করিবে, সাত্ত্বিক কার্যে নিযুক্ত হইবে, তাহা হইলে ব্যক্তির ও জাতির মঙ্গল সম্ভব ৷ সত্ত্ব যদি রজঃকে গ্রাস করে, রজঃ যদি সত্ত্বকে গ্রাস করে, তম বিজয়ী গুণ স্বয়ং পরাজিত হয়, তমােগুণের রাজ্য হয় ৷ ব্রাহ্মণ কখনও রাজা হইতে পারে না, ক্ষত্রিয় বিনষ্ট হইলে শূদ্র রাজা হইবে, ব্রাহ্মণ তামসিক হইয়া অর্থলােভে জ্ঞানকে বিকৃত করিয়া শূদ্রের দাস হইবে, আধ্যাত্মিক ভাব নিশ্চেষ্টতাকে পােষণ করিবে, স্বয়ং ম্লান হইয়া ধৰ্ম্মের অবনতির কারণ হইবে ৷ নিঃক্ষত্রিয় শূদ্ৰচালিত জাতির দাসত্ব অবশ্যম্ভাবী ৷ ভারতের এই অবস্থা ঘটিয়াছে ৷ অপরপক্ষে আসুরিক বলের প্রভাবে ক্ষণিক উত্তেজনায় শক্তিসঞ্চার ও মহত্ব হইতে পারে বটে, কিন্তু শীঘ্র হয় দুর্বলতা, গ্লানি ও শক্তিক্ষয় হইয়া দেশ অবসন্ন হইয়া পড়ে, নয় রাজসিক বিলাস, দম্ভ ও স্বার্থের বৃদ্ধিতে জাতি অনুপযুক্ত হইয়া মহত্ত্বরক্ষায় অসমর্থ হয়, নয় অন্তর্বিরােধে, দুর্নীতিতে, অত্যাচারে দেশ ছারখার হইয়া শত্রুর সহজলভ্য শিকার হয় ৷ ভারতের ও য়ুরােপের ইতিহাসে এই সকল পরিণামের ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় ৷
মহাভারতের সময়ে আসুরিক বলের ভারে পৃথিবী অস্থির হইয়াছিল ৷ ভারতের এমন তেজস্বী পরাক্রমশালী প্রচণ্ড ক্ষত্রিয়তেজের বিস্তার পূর্বেও হয় নাই, পরেও হয় নাই, কিন্তু ভীষণ বলের সদুপযােগ হইবার সম্ভাবনা অতিশয় কম ছিল ৷ যাঁহারা এই বলের আধার ছিলেন, তাহারা সকলেই অসুরপ্রকৃতির – অহঙ্কার, দর্প, স্বার্থ, স্বেচ্ছাচার তাহাদের মজ্জাগত ছিল ৷ যদি শ্রীকৃষ্ণ এই বল বিনাশ করিয়া ধৰ্ম্মরাজ্য স্থাপন না করিতেন, তাহা হইলে যে তিন প্রকার পরিণাম বর্ণনা করিয়াছি, তাহার একটী না একটী নিশ্চয় ঘটিত ৷ ভারত অসময়ে স্নেচ্ছের হাতে পড়িত ৷ মনে রাখা উচিত পঞ্চ সহস্র বৎসর পূর্বে কুরুক্ষেত্ৰযুদ্ধ ঘটিয়াছে, আড়াই হাজার বৎসর অতিবাহিত হইবার পরে ম্লেচ্ছদের প্রথম সফল আক্রমণ ৷ সিন্ধুনদীর অপর পার পর্যন্ত পৌঁছিতে পারিয়াছে ৷ অতএব অর্জুন-প্রতিষ্ঠিত ধৰ্ম্ম-রাজ্য এতদিন ব্ৰহ্মতেজ-অনুপ্রাণিত ক্ষত্ৰতেজের প্রভাবে দেশকে রক্ষা করিয়াছে ৷ তখনও সঞ্চিত ক্ষত্ৰতেজ দেশে এত ছিল যে তাহার ভগ্নাংশই দুই সহস্র বর্ষ দেশকে বাঁচাইয়া রাখিয়াছে; চন্দ্রগুপ্ত, পুষ্যমিত্র, সমুদ্রগুপ্ত, বিক্রম, সংগ্ৰামসিংহ, প্রতাপ, রাজসিংহ, প্রতাপাদিত্য, শিবাজী ইত্যাদি মহাপুরুষ সেই ক্ষত্ৰতেজের বলে দেশের দুর্ভাগ্যের সঙ্গে সংগ্রাম করিয়াছেন ৷ সেই দিনই গুজরাটযুদ্ধে ও লক্ষ্মীবাইয়ের চিতায় তাহার শেষ স্ফুলিঙ্গ নির্বাপিত হইল ৷ তখন শ্রীকৃষ্ণের রাজনীতিক কার্য্যের সুফল ও পুণ্য ক্ষয় হইয়া গেল, ভারতকে, জগৎকে রক্ষা করিবার জন্য আবার পূর্ণাবতারের আবশ্যকতা হইল ৷ সেই অবতার আবার লুপ্ত ব্ৰহ্মতেজ জাগাইয়া গেলেন, সেই ব্রহ্মতেজ ক্ষত্ৰতেজ সৃষ্টি করিবে ৷ শ্রীকৃষ্ণ ভারত্রে ক্ষত্ৰতেজ কুরুক্ষেত্রের রক্তসমুদ্রে নিৰ্বাপিত করেন নাই, বরং আসুরিক বল বিনাশ করিয়া ব্রহ্মতেজ ও ক্ষত্ৰতেজ উভয়কেই রক্ষা করিয়াছেন ৷ আসুরিক বলদৃপ্ত ক্ষত্রিয়বংশের সংহারে উদ্দাম রজঃ-শক্তিকে ছিন্ন ভিন্ন করিয়া দিলেন, ইহা সত্য ৷ এইরূপ মহাবিপ্লব, অন্তর্বিরােধকে উৎকট ভােগ দ্বারা ক্ষয় করিয়া নিগৃহীত করা, উদ্দাম ক্ষত্রিয়কুল সংহার সর্বদা অনিষ্টকর নয় ৷ অন্তর্বিরােধে রােমান ক্ষত্রিয়কুলনাশে ও রাজতন্ত্র-স্থাপনে রােমের বিরাট সাম্রাজ্য অকালবিনাশের গ্রাস হইতে রক্ষা পাইয়াছিল ৷ ইংলণ্ডে শ্বেত ও রক্ত গােলাপের অন্তর্বিরােধে ক্ষত্রিয়কুলনাশে চতুর্থ এডওয়ার্ড, অষ্টম হেনরি ও রাণী এলিজাবেথ সুরক্ষিত পরাক্রমশালী বিশ্ববিজয়ী আধুনিক ইংলণ্ডের ভিত্তি স্থাপন করিতে পারিয়াছিলেন ৷ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে ভারতও সেইরূপে রক্ষা পাইল ৷
কলিযুগে ভারতের অবনতি হইয়াছে, তাহা কেহ অস্বীকার করিতে পারে না ৷ কিন্তু অবনতি আনয়ন করিবার জন্য ভগবান কখন অবতীর্ণ হন নাই ৷ ধৰ্ম্মরক্ষা, বিশ্বরক্ষা, লােকরক্ষার জন্য অবতার ৷ বিশেষতঃ কলিযুগেই ভগবান পূর্ণভাবে অবতীর্ণ হন, তাহার কারণ, কলিতে মানুষের অবনতির অধিক ভয়, অধৰ্ম্মবৃদ্ধি স্বাভাবিক, অতএব মানবজাতির রক্ষার জন্য, অধৰ্ম্মনাশ ও ধৰ্ম্মস্থাপনের জন্য, কলির গতি রুদ্ধ করিবার জন্য এই যুগে পুনঃ পুনঃ অবতার হয় ৷ শ্রীকৃষ্ণ যখন অবতীর্ণ হইলেন, কলির রাজ্য আরম্ভ হইবার সময় হইয়াছিল, তাহারই আবির্ভাবে ভীত হইয়া কলি নিজের রাজ্যে পদস্থাপন করিতে পারেন নাই, তাহারই প্রসাদে পরীক্ষিত কলিকে পঞ্চ গ্রাম দান করিয়া তাহারই যুগে তাহার একাধিপত্য স্থগিত করিয়া রাখিলেন ৷ যে কলিযুগের আদি হইতে শেষ পর্যন্ত কলির সঙ্গে মানবের ঘাের সংগ্রাম চলিতেছে ও চলিবে, সেই সংগ্রামের সহায় ও নায়করূপে ভগবানের ৷ অবতার ও বিভূতি কলিতে ঘন ঘন আসেন, সেই সংগ্রামের উপযােগী ব্রহ্মতেজ, জ্ঞান, ভক্তি, নিষ্কাম কৰ্ম্মের শিক্ষা ও রক্ষা করিতে ভগবান কলির মুখে মানবশরীর ধারণ করিয়াছিলেন ৷ ভারতের রক্ষা মানবকল্যাণের ভিত্তি ও আশস্থল ৷ ভগবান কুরুক্ষেত্রে ভারতের রক্ষা করিয়াছেন ৷ সেই রক্তসমুদ্রে নূতন জগতের লীলাপদ্মে কালরূপী বিরাটপুরুষ বিহার করিতে আরম্ভ করিলেন ৷
দ্বিতীয় অধ্যায়
তং তথা কৃপয়াবিষ্টমপূর্ণাকুলেক্ষণ ৷ বিষীদন্তমিদং বাক্যমুবাচ মধুসূদনঃ ॥১॥
মধুসূদন অৰ্জ্জুনের কৃপার আবেশ, অশ্রুপূর্ণ চক্ষুদ্বয় ও বিষন্নভাব দেখিয়া তাহাকে এই প্রত্যুত্তর করিলেন ৷
শ্রীভগবানুবাচ
কুতত্ত্বা কলমিদং বিষমে সমুপস্থিত ৷ অনাৰ্যজুষ্টমস্বর্গমকীৰ্ত্তিকরমৰ্জ্জুন ॥২॥
শ্রীভগবান বলিলেন, –
“হে অর্জুন! এই সঙ্কট সময়ে এই অনাৰ্য্যের আদৃত স্বর্গপথরােধক অকীর্তি-কর মনের মলিনতা কোথা হইতে উপস্থিত?
ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ নৈতৎ ত্বপপদ্যতে ৷ ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্কোত্তিষ্ঠ পরন্তপ ॥৩॥
“হে পৃথাতনয়! হে শত্রুদমনে সমর্থ! ক্লীবত্ব আশ্রয় করিও না, ইহা তােমার সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত ৷ এই ক্ষুদ্র মনের দুর্বলতা পরিত্যাগ কর, ওঠ ৷”
শ্রীকৃষ্ণের উত্তর
শ্রীকৃষ্ণ দেখিলেন অর্জুন কৃপায় আবিষ্ট হইয়াছে, বিষাদ তাহাকে গ্রাস করিয়াছে ৷ এই তামসিক ভাব অপনােদন করিবার জন্য অন্তর্যামী তাঁহার প্রিয় সখাকে ক্ষত্রিয়ােচিত তিরস্কার করিলেন, তাহাতে যদি রাজসিক ভাব জাগরিত হইয়া তমঃকে দূর করে ৷ তিনি বলিলেন, দেখ, ইহা তােমার স্বপক্ষের সঙ্কটকাল, এখন যদি তুমি অস্ত্র পরিত্যাগ কর, তাহাদের সম্পূর্ণ বিপদ ও বিনাশের সম্ভাবনা আছে ৷ রণক্ষেত্রে স্বপক্ষত্যাগ তােমার ন্যায় ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠের মনে উঠিবার কথা নয়, কোথা হইতে হঠাৎ এই দুৰ্ম্মতি? তােমার ভাব দুৰ্বলতাপূর্ণ, পাপপূর্ণ ৷ অনাৰ্য্যগণ এই ভাব প্রশংসা করে, তাহার বশ হয়, কিন্তু তাহা আৰ্য্যের অনুচিত, তাহাতে পরলােকে স্বর্গপ্রাপ্তির বিঘ্ন হয় এবং ইহলােকে যশ ও কীর্তির লােপ হয় ৷ তাহার পরে আরও মর্মভেদী তিরস্কার করিলেন ৷ এই ভাব ক্লীবােচিত, তুমি বীরশ্রেষ্ঠ, তুমি জেতা, তুমি কুন্তির পুত্র, তুমি এইরূপ কথা বল? এই প্রাণের দুর্বলতা ত্যাগ কর, ওঠ, তােমার কর্তব্যকর্মে উদ্যোগী হও ৷
কৃপা ও দয়া
কৃপা ও দয়া স্বতন্ত্র ভাব, এমন কি কৃপা দয়ার বিরােধী ভাবও হইতে পারে ৷ আমরা দয়ার বশে জগতের কল্যাণ করি, মানুষের দুঃখ, জাতির দুঃখ, পরের দুঃখ মােচন করি ৷ যদি নিজের দুঃখ বা ব্যক্তিবিশেষের দুঃখ সহ্য না করিতে পারিয়া সেই কল্যাণসাধনে নিবৃত্ত হই, তাহা হইলে আমার দয়া নাই, কৃপারই আবেশ হইয়াছে ৷ সমস্ত মানবজাতির বা দেশের দুঃখমােচন করিতে উঠিলাম, সেই ভাব দয়ার ৷ রক্তপাতের ভয়ে, প্রাণীহিংসার ভয়ে সেই পুণ্যকাৰ্য্যে বিরত হইলাম, জগতের, জাতির দুঃখের চিরস্থায়িতায় সায় দিলাম, এই ভাব কৃপার ৷ লােকের দুঃখে দুঃখী হইয়া যে দুঃখমােচনের প্রবল প্রবৃত্তি তাহাকে দয়া বলে ৷ পরের দুঃখচিন্তায় বা দুঃখদর্শনে কাতর হওয়া, এই ভাবকে কৃপা বলে ৷ কাতরতা দয়া নহে, কৃপা ৷ দয়া বলবানের ধৰ্ম্ম, কৃপা দুর্বলের ধর্ম ৷ দয়ার আবেশে বুদ্ধদেব স্ত্রীপুত্র, পিতামাতা, বন্ধুবান্ধবকে দুঃখী ও হাতসৰ্বস্ব করিয়া জগতের দুঃখমােচন করিতে নির্গত হইলেন ৷ তীব্র দয়ার আবেশে উন্মত্ত কালী জগৎময় অসুর সংহার করিয়া পৃথিবীকে রক্তপ্লাবিত করিয়া সকলের দুঃখমােচন করিলেন ৷ অর্জুন কৃপার আবেশে শস্ত্র পরিত্যাগ করিয়াছিলেন ৷
এই ভাব অনাৰ্য্য-প্রশংসিত, অনাৰ্য্য-আচরিত ৷ আৰ্য্যশিক্ষা উদার, বীরােচিত, দেবতার শিক্ষা ৷ অনাৰ্য মােহে পড়িয়া অনুদার ভাবকে ধৰ্ম্ম বলিয়া উদার ধর্ম পরিত্যাগ করে ৷ অনাৰ্য্য রাজসিকভাবে ভাবান্বিত হইয়া নিজের, প্রিয়জনের, নিজ পরিবারের বা কুলের হিত দেখে, বিরাট কল্যাণ দেখে না, কৃপায় ধর্মপরায়ুখ হইয়া নিজেকে পূণ্যবান বলিয়া গৰ্ব করে, কঠোরব্রতী আৰ্য্যকে নিষ্ঠুর ও অধার্মিক বলে ৷ অনাৰ্য্য তামসিক মােহে মুগ্ধ হইয়া অপ্রবৃত্তিকে নিবৃত্তি বলে, সকাম পুণ্যপ্রিয়তাকে ধৰ্ম্মনীতির উধ্বতম আসন প্রদান করে ৷ দয়া আৰ্য্যের ভাব ৷ কৃপা অনার্য্যের ভাব ৷
পুরুষ দয়ার বশে বীরভাবে পরের অমঙ্গল ও দুঃখকে বিনাশ করিবার জন্য অমঙ্গলের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয় ৷ নারী দয়ার বশে পরের দুঃখলাঘবের জন্যে শুশ্রষায়, যত্নে ও পরহিতচেষ্টায় সমস্ত প্রাণ ও শক্তি ঢালিয়া দেয় ৷ যে কৃপার বশে অস্ত্র পরিত্যাগ করে, ধৰ্ম্মে পরাজুখ হয়, কাদিতে বসিয়া ভাবে আমার কৰ্তব্য করিতেছি, আমি পুণ্যবান, – সে ক্লীব ৷ এই ভাব ক্ষুদ্র, এই ভাব দুর্বলতা ৷ বিষাদ কখন ধৰ্ম্ম হইতে পারে না ৷ যে বিষাদকে আশ্রয় দেয়, সে পাপকে আশ্রয় দেয় ৷ এই চিত্তমলিনতা, এই অশুদ্ধ ও দুৰ্বলভাব পরিত্যাগ করিয়া যুদ্ধে উদ্যোগী হইয়া কর্তব্যপালনে জগতের রক্ষা, ধৰ্ম্মের রক্ষা, পৃথিবীর ভার লাঘব করাই শ্রেয়ঃ ৷ ইহাই শ্রীকৃষ্ণের এই উক্তির মর্ম ৷
কথং ভীষ্মমহং সংখ্যে দ্রোণঞ্চ মধুসূদন ৷ ইমুভিঃ প্রতিযােৎস্যামি পূজাৰ্হাবরিসূদন ॥৪॥
“হে মধুসূদন, হে শত্রুনাশকারী, আমি কিরূপে ভীষ্ম ও দ্রোণকে যুদ্ধে প্রতিরােধ করিয়া সেই পূজনীয় গুরুজনের বিরুদ্ধে অস্ত্রনিক্ষেপ করিব?
গুরূনহত্বা হি মহানুভাবান্ শ্ৰেয়াে ভােক্তং ভৈক্ষ্যমপীহ লােকে ৷ হত্বার্থকামাংস্তু গুরূনিহৈব ভুঞ্জীয় ভােগান্ রুধিরপ্রদিগ্ধান্ ॥৫॥
এই উদারচেতা গুরুজনকে বধ না করিয়া পৃথিবীতে ভিখারীর অবস্থা ভােগ করা শ্রেয়ঃ ৷ গুরুজনকে যদি বধ করি, ধৰ্ম্ম ও মােক্ষ হারাইয়া কেবল অর্থ ও কাম ভােগ করিব, সেও রুধিরাক্ত বিষয়ভােগ এবং পৃথিবীতেই ভােগ্য, প্রাণত্যাগ পৰ্য্যন্ত থাকে ৷
ন চৈতদবিঘ্নঃ কতরন্নো গরীয়াে যা জয়েম যদি বা নাে জয়েয়ুঃ ৷ যানেব হত্বা ন জিজীবিষামস্তেহবস্থিতাঃ প্রমুখে ধার্তরাষ্ট্রাঃ ॥৬॥
সেই হেতু আমাদের জয় বা পরাজয়, কোন্টী অধিক প্রার্থনীয়, তাহা আমরা বুঝিতে পারি না ৷ যাঁহাদিগকে বধ করিলে আমাদের জীবিত থাকিবার কোন ইচ্ছা থাকিবে না, তাহারাই বিপক্ষীয় সৈন্যের অগ্রভাগে উপস্থিত, তাহারা ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রগণের সৈন্যনায়ক ৷
কার্পণ্যদোষােপহতস্বভাবঃ পৃচ্ছামি ত্বং ধৰ্ম্মসংমূঢ়চেতাঃ ৷ যচ্ছেয়ঃ স্যানিশ্চিতং ব্রহি তন্মে শিষ্যস্তেহহং শাধি মাং ত্বং প্রপন্নম্ ॥৭॥
দীনতা দোষে আমার ক্ষত্রিয়স্বভাব অভিভূত হইয়াছে, ধৰ্ম্মাধর্ম সম্বন্ধে আমার বুদ্ধি বিমূঢ়, সেইজন্য তােমাকে প্রশ্ন করিতেছি, তুমি আমাকে কিসেতে শ্রেয়ঃ হইবে নিশ্চিতভাবে তাহা বল, আমি তােমার শিষ্য, তােমার নিকট শরণ লইলাম, আমাকে শিক্ষা দাও ৷
ন হি প্রপশ্যামি মমাপনুদ্যা যচ্ছােকমুচ্ছােষণমিন্দ্রিয়াণাম্ ৷ অবাপ্য ভূমাবসপত্নমৃদ্ধং রাজ্যং সুরাণামপি চাধিপত্যম্ ॥৮॥
কেন না, পৃথিবীতে অসপত্ন রাজ্য এবং দেবগণের উপরও আধিপত্য লাভ করিলেও এই শােক আমার সকল ইন্দ্রিয়ের তেজ শােষণ করিয়া লইবে, সেই শােকাপনােদনের কোন উপায় আমি দেখি না ৷”
অর্জুনের শিক্ষাপ্রার্থনা
শ্রীকৃষ্ণের উক্তির উদ্দেশ্য অর্জুন বুঝিতে পারিলেন, তিনি রাজনীতিক আপত্তি উত্থাপন করিতে বিরত হইলেন, কিন্তু আর যে যে আপত্তি ছিল, তাহার কোন উত্তর না পাইয়া শ্রীকৃষ্ণের নিকট শিক্ষার্থে শরণাগত হইলেন ৷ তিনি বলিলেন, “আমি স্বীকার করি আমি ক্ষত্রিয়, কৃপার বশবর্তী হইয়া মহৎ কাৰ্য্যে বিরত ৷ হওয়া আমার পক্ষে ক্লীবত্বসূচক, অকীৰ্ত্তিজনক, ধৰ্ম্মবিরুদ্ধ ৷ কিন্তু মনও মানে , প্রাণও মানে না ৷ মন বলে, গুরুজন হত্যা মহাপাপ, নিজ সুখের জন্য গুরুজনকে হত্যা করিলে অধর্মে পতিত হইয়া ধৰ্ম্ম, মােক্ষ, পরলােক, যাহা বাঞ্ছনীয়, সকলই যাইবে ৷ কামনা তৃপ্ত হইবে, অর্থস্পৃহা তৃপ্ত হইবে, কিন্তু সে কয়দিন? অধৰ্ম্মলব্ধ ভােগ প্রাণত্যাগ পৰ্য্যন্ত স্থায়ী, তাহার পর অনির্বচনীয় দুর্গতি হয় ৷ আর যখন ভােগ করিবে, তখন সেই ভােগের মধ্যে গুরুজনের রক্তের আস্বাদ পাইয়া কি সুখ বা শান্তি হইবে? প্রাণ বলে, ইহারা আমার প্রিয়জন, ইহাদের হত্যা করিলে আমি আর এই জন্মে সুখভােগ করিতে পারিব না, বাঁচিতেও চাই না ৷ তুমি যদি আমাকে সমস্ত পৃথিবীর সাম্রাজ্যভােগ দাও বা স্বর্গ জয় করিয়া ইন্দ্রের ঐশ্বৰ্য্যভােগ দাও, আমি কিন্তু শুনিব না ৷ যে শােক আমাকে অভিভূত করিবে, তাহা দ্বারা সমস্ত কৰ্ম্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয় অভিভূত ও অবসন্ন হইয়া স্ব স্ব কাৰ্য্যে শিথিল ও অসমর্থ হইবে, তখন তুমি কি ভােগ করিবে? আমার বিষম চিত্তের দীনতা উপস্থিত, মহান্ ক্ষত্রিয়স্বভাব সেই দীনতায় ডুবিয়া গিয়াছে ৷ আমি তােমার নিকট শরণ লইলাম ৷ আমাকে জ্ঞান, শক্তি, শ্রদ্ধা দাও, শ্রেয়ঃপথ দেখাইয়া রক্ষা কর ৷”
ভগবানের নিকট সম্পূর্ণভাবে শরণাগত হওয়া গীতােক্ত যােগের পন্থা ৷ ইহাকে আত্মসমর্পণ বা আত্মনিবেদন বলে ৷ যিনি ভগবানকে গুরু, প্রভু, সখা, পথপ্রদর্শক বলিয়া আর সকল ধর্মকে জলাঞ্জলি দিতে প্রস্তুত, পাপ পুণ্য, কর্তব্য অকৰ্ত্তব্য, ধৰ্ম্ম অধর্ম, সত্য অসত্য, মঙ্গল অমঙ্গল বিচার না করিয়া নিজ জ্ঞান কৰ্ম্ম ও সাধনার সমস্ত ভাব শ্রীকৃষ্ণকে অর্পণ করেন, তিনিই গীতােক্ত যােগের অধিকারী ৷ অর্জন শ্রীকৃষ্ণকে বলিলেন, তুমি যদি গুরুহত্যাও করিতে বল, ইহাকে ধৰ্ম্ম ও কর্তব্যকৰ্ম্ম বলিয়া বুঝাইয়া দাও, আমি তাহাই করিব ৷ এই গভীর শ্রদ্ধার বলে অৰ্জ্জুন সমসাময়িক সকল মহাপুরুষকে অতিক্রম করিয়া গীতােক্ত শিক্ষার শ্রেষ্ঠ পাত্র বলিয়া গৃহীত হইলেন ৷
উত্তরে শ্রীকৃষ্ণ প্রথম অর্জুনের দুই আপত্তি খণ্ডন করিয়া তাহার পরে গুরুর ভার গ্রহণ করিয়া আসল জ্ঞান দিতে আরম্ভ করিলেন ৷ ৩৮ শ্লোক পৰ্য্যন্ত আপত্তিখণ্ডন, তাহার পরে গীতােক্ত শিক্ষার আরম্ভ হয় ৷ কিন্তু এই আপত্তিখণ্ডনের মধ্যে কয়েকটী অমূল্য শিক্ষা পাওয়া যায়, যাহা না বুঝিলে গীতার শিক্ষা হৃদয়ঙ্গম হয় না ৷ এই কয়েকটী কথা বিস্তারিত ভাবে আলােচনা করা প্রয়ােজন ৷
এবমুত্ত্বা হৃষীকেশং গুড়াকেশঃ পরন্তপঃ ৷ ন যােৎস্য ইতি গােবিন্দমুত্ত্বা তুষ্ণীং বভূব হ॥৯॥
পরন্তপ গুড়াকেশ হৃষীকেশকে এই কথা বলিয়া আবার সেই গােবিন্দকে বলিলেন, “আমি যুদ্ধ করিব না” এবং নীরব হইয়া রহিলেন ৷
তমুবাচ হৃষীকেশঃ প্রহসন্নিব ভারত ৷ সেনয়ােরুভয়াের্মধ্যে বিষীদন্তমিদং বচঃ ॥১০॥
শ্রীকৃষ্ণ ঈষদ হাস্য করিয়া দুই সেনার মধ্যস্থলে বিষন্ন অর্জুনকে এই উত্তর দিলেন ৷
অশােচ্যানন্বশােচং প্রজ্ঞাবাদাংশ্চ ভাষসে ৷ গতাসূনগতাসূংশ্চ নানুশােচন্তি পণ্ডিতাঃ ॥১১॥
“যাহাদের জন্য শােক করার কোন কারণ নাই, তুমি তাহাদের জন্য শােক কর, অথচ জ্ঞানীর ন্যায় তত্ত্বকথা লইয়া বাদবিবাদ করিতে চেষ্টা কর, কিন্তু যাঁহারা তত্ত্বজ্ঞানী তাহারা মৃত বা জীবিত কাহারও জন্য শােক করেন না ৷
ন ত্বেবাহং জাতু নাসং ন ত্বং নেমে জনাধিপাঃ ৷ ন চৈব ন ভবিষ্যামঃ সৰ্ব্বে বয়মতঃপরম্ ॥১২॥
ইহাও নহে যে আমি পূৰ্বে ছিলাম না বা তুমি ছিলে না বা এই নৃপতিবৃন্দ ছিল না, ইহাও নহে যে আমরা সকলে দেহত্যাগের পরে আর থাকিব না ৷
দেহিনােহস্মিন্ যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা ৷ তথা দেহান্তরপ্রাপ্তিধীরস্ত ন মুহ্যতি ॥১৩॥
যেমন এই জীব-অধিষ্ঠিত দেহে বাল্য, যৌবন, বার্ধক্য কালের গতিতে হয়, তেমনই দেহান্তরপ্রাপ্তিও কালের গতিতে হয়, তাহাতে স্থিরবুদ্ধি জ্ঞানী বিমূঢ় হন না ৷
মাত্ৰাস্পর্শাস্তু কৌন্তেয় শীতােষ্ণসুখদুঃখদাঃ ৷ আগমাপায়িনােহনিত্যাস্তাংস্তিতিক্ষস্ব ভারত ॥১৪॥
মরণ কিছুই নয়, যে বিষয়ম্পর্শে শীত, উষ্ণ, সুখ, দুঃখ ইত্যাদি সংস্কার সৃষ্ট হয়, সেই স্পর্শসকল অনিত্য, আসে, যায়, সেইসকল অবিচলিত হইয়া গ্রহণ করিবার অভ্যাস কর ৷
যং হি ন ব্যথয়ন্ত্যেতে পুরুষং পুরুষর্ষভ ৷ সমদুঃখসুখং ধীরং সােহমৃতত্বায় কল্পতে ॥১৫॥
যে স্থিরবুদ্ধি পুরুষ এই স্পর্শসকল ভােগ করিয়াও ব্যথিত হন না, তৎসৃষ্ট সুখ দুঃখ সমভাবে গ্রহণ করেন, তিনিই মৃত্যু জয় করিতে সক্ষম হন ৷
নাসতাে বিদ্যতে ভাবাে নাভাবাে বিদ্যতে সতঃ ৷ উভয়ােরপি দৃষ্টোন্তনয়ােস্তত্ত্বদর্শিভিঃ ॥১৬॥
যাহা অসৎ তাহার অস্তিত্ব হয় না, যাহা সৎ তাহার বিনাশ হয় না, তথাপি সৎ ও অসৎ দুইটীর অন্ত হয়, ইহা তত্ত্বদর্শীগণ দর্শন করিয়াছেন ৷
অবিনাশী তু তদ্বিদ্ধি যেন সৰ্ব্বমিদং ততম ৷ বিনাশমব্যয়স্যাস্য ন কশ্চিৎ কর্তৃর্মহতি ॥১৭॥
কিন্তু যাহা এইসমস্ত দৃশ্যজগৎ নিজের মধ্যে বিস্তার করিয়াছেন, সেই আত্মার ক্ষয় হয় না, কেহ তাহার ধ্বংস করিতে পারে না ৷
অবন্ত ইমে দেহা নিত্যস্যোক্তাঃ শরীরিণঃ ৷ অনাশিনােহপ্রমেয়স্য তস্মাদ যুধ্যস্ব ভারত ॥১৮॥
নিত্য দেহাশ্রিত আত্মার এই সকল দেহের অন্ত আছে, আত্মা অসীম ও অনশ্বর; অতএব, হে ভারত, যুদ্ধ কর ৷
য এনং বেত্তি হন্তারং যশ্চৈনং মন্যতে হত ৷ উভৌ তৌ ন বিজানীতাে নায়ং হন্তি ন হন্যতে ॥১৯॥
যিনি আত্মাকে হন্তা বলেন এবং যিনি দেহনাশে আত্মাকে নিহত বলিয়া বােঝেন, দুই জনই ভ্রান্ত, অজ্ঞ, এই আত্মা হত্যাও করে না, হতও হয় না ৷
ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ ৷ অজো নিত্যঃ শাশ্বতােহয়ং পুরাণাে ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে ॥২০॥
এই আত্মার জন্ম নাই, মৃত্যু নাই, তাহার কখনও উদ্ভব হয় নাই এবং কখনও লােপ হইবে না ৷ সে জন্মরহিত, নিত্য, সনাতন, পুরাতন, দেহনাশে হত হয় না ৷
বেদাবিনাশিনং নিত্যং য এনমজমব্যয়ম্ ৷ কথং স পুরুষঃ পার্থ! কং ঘাতয়তি হন্তি কম্ ॥২১॥
যিনি ইহাকে নিত্য, অনশ্বর ও অক্ষয় বলিয়া জানেন, সেই পুরুষ কিরূপে কাহাকে হত্যা করেন বা করান?
বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্নাতি নরােহপরাণি ৷ তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহী ॥২২॥
যেমন মানুষ জীর্ণ বস্ত্র ফেলিয়া অন্য নূতন বস্ত্র গ্রহণ করে, সেই রূপেই জীব জীর্ণ দেহ ফেলিয়া অন্য নূতন দেহকে আশ্রয় করে ৷
নৈনং ছিন্দন্তি শস্রাণি, নৈনং দহতি পাবকঃ ৷ ন চৈনং ক্লেদয়্যাপাে ন শােষয়তি মারুতঃ ॥২৩॥
শস্ত্রসকল ইহাকে ছেদন করিতে পারে না, অগ্নি দহন করিতে পারে না, জল ভিজাইতে পারে না, বায়ু শুষ্ক করিতে পারে না ৷
অচ্ছেদ্যোইয়মদাহ্যোয়মক্লেদ্যোইশােষ্য এব চ ৷ নিত্যঃ সৰ্ব্বগতঃ স্থাণুরচলােহয়ং সনাতনঃ ॥২৪॥
আত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য, অশােষ্য, নিত্য, সৰ্বব্যাপী, স্থির, অচল, সনাতন ৷
অব্যক্তোইয়মচিন্ত্যোহয়মবিকাৰ্য্যোয়মুচ্যতে ৷ তস্মাদেবং বিদিত্বৈনং নানুশােচিতুমহসি ॥২৫॥
আত্মা অব্যক্ত, অচিন্ত্য, বিকাররহিত ৷ তুমি আত্মাকে এইরূপ জানিয়া শােক করা পরিত্যাগ কর ৷
অথ চৈনং নিত্যজাতং নিত্যং বা মন্যসে মৃতম্ ৷ তথাপি ত্বং মহাবাহাে নৈনং শােচিতুমহসি ॥২৬॥
আর যদি তুমি মনে কর যে জীব বার বার জন্মায় ও মরে, তাহা হইলেও তাহার জন্য শােক করা উচিত নয় ৷
জাতস্য হি ধ্রুবাে মৃত্যুবং জন্ম মৃতস্য চ ৷ তস্মাদপরিহার্য্যেহর্থে ন ত্বং শােচিতুমহসি ॥২৭॥
যাহার জন্ম হয়, তাহার নিশ্চয় মরণ হয়, যাহার মরণ হয়, তাহার নিশ্চয় জন্ম হয়, অতএব যখন মৃত্যু অপরিহার্য্য পরিণাম, তাহার জন্য শােক করা অনুচিত ৷
অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত ৷ অব্যক্তনিধনান্যেব তত্র কা পরিদেবনা ॥২৮॥
সকল প্রাণী প্রথমে অব্যক্ত হইয়া থাকে, মাঝে ব্যক্ত হয়, আবার অব্যক্ত হয়, এই স্বাভাবিক ক্রমে শােক করিবার কোনও কারণ নাই ৷
আশ্চৰ্য্যবৎ পশ্যতি কশ্চিদেনমাশ্চৰ্য্যবদ বদতি তথৈব চান্যঃ ৷ আশ্চৰ্য্যবচ্চৈনমন্যঃ শৃণােতি শ্রুত্বাপ্যেনং বেদ ন চৈব কশ্চিৎ ॥২৯॥
আত্মাকে কেহ আশ্চৰ্য্য কিছু বলিয়া দেখেন, কেহ আশ্চৰ্য্য কিছু বলিয়া তাহার কথা বলেন, কেহ আশ্চৰ্য্য কিছু বলিয়া তাহার কথা শুনেন, কিন্তু শুনিয়াও কেহ আত্মাকে জানিতে পারেন নাই ৷
দেহী নিত্যমবধ্যোহয়ং দেহে সর্বস্য ভারত ৷ তস্মাৎ সর্বাণি ভূতানি ন ত্বং শােচিতুমহসি ॥৩০॥
আত্মা সর্বদা সকলের দেহের মধ্যে অবধ্য হইয়া থাকে, অতএব এই সকল প্রাণীর জন্য কখন শােক করা উচিত নহে ৷”
মৃত্যুর অসত্যতা
অর্জুনের কথা শুনিয়া শ্রীকৃষ্ণের মুখে হাসির ভাব প্রকাশ হইল, সেই হাসি রঙ্গময় অথচ প্রসন্নতাপূর্ণ, – অৰ্জ্জুনের ভ্রমে মানবজাতির পুরাতন ভ্রম চিনিয়া অন্তর্যামী হাসিলেন, সেই ভ্রম শ্রীকৃষ্ণেরই মায়াপ্রসূত, জগতে অশুভ, দুঃখ ও দুর্বলতা ভােগ ও সংযম দ্বারা ক্ষয় করিবার জন্য তিনি মানবকে এই মায়ার বশীভূত করিয়াছেন ৷ প্রাণের মমতা, মরণের ভয়, সুখ-দুঃখের অধীনত্ব, প্রিয় ও অপ্রিয় বােধ, ইত্যাদি অজ্ঞান অর্জুনের কথায় প্রকাশ পাইয়াছে, ইহাই মানবের বুদ্ধি হইতে দূর করিয়া জগৎকে অশুভমুক্ত করিতে হইবে, সেই শুভ কার্য্যের অনুকূল অবস্থা প্রস্তুত করিবার জন্য শ্রীকৃষ্ণ আসিয়াছেন, গীতা প্রকাশ করিতে যাইতেছেন ৷ কিন্তু প্রথম অর্জুনের মনে যে ভ্রম উৎপন্ন হইয়াছে, তাহা ভােগ দ্বারা ক্ষয় করিতে হইবে ৷ অৰ্জ্জুন শ্রীকৃষ্ণের সখা, মানবজাতির প্রতিনিধি, তাঁহাকেই গীতা প্রদর্শিত হইবে, তিনি শ্রেষ্ঠ পাত্র; কিন্তু মানবজাতি এখনও গীতার অর্থ গ্রহণের যােগ্য হয় নাই, অৰ্জ্জুনও সম্পূর্ণ অর্থ গ্রহণ করিতে পারেন নাই ৷ যে শােক, দুঃখ ও কাতরতা তাহার মনে উঠিয়াছিল, তাহা মানবজাতি কলিযুগে সম্পূর্ণ ভােগ করিয়া আসিতেছে, খ্রীষ্টধর্ম প্রেম আনয়ন করিয়া, বৌদ্ধধৰ্ম্ম দয়া আনয়ন করিয়া, ইসলামধৰ্ম্ম শক্তি আনয়ন করিয়া সেই দুঃখভােগ লাঘব করিতে আসিয়াছে ৷ আজ কলিযুগান্তর্গত প্রথম খণ্ড সত্যযুগ আরম্ভ হইবে, ভগবান আবার ভারতকে, কুরুজাতির বংশধরগণকে গীতা প্রদান করিতেছেন, যদি গ্রহণ করিতে, ধারণ করিতে সমর্থ হই, তাহা হইলে ভারতের মঙ্গল, জগতের মঙ্গল সুনিশ্চিত ফল ৷
শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন, অর্জুন, তুমি পণ্ডিতের ন্যায় পাপপুণ্য বিচার করিতেছ, জীবন-মরণের তত্ত্ব বলিতেছ, জাতির কল্যাণ অকল্যাণ কিসে হয় তাহা প্রতিপাদন করিবার চেষ্টা করিতেছ, কিন্তু প্রকৃত জ্ঞানের পরিচয় তােমার কথার মধ্যে পাওয়া যায় না, বরং তােমার প্রত্যেক কথা ঘাের অজ্ঞানপূর্ণ ৷ স্পষ্ট কথা বল, আমার হৃদয় দুর্বল, শােকে কাতর, বুদ্ধি কৰ্ত্তব্যপরাঘুখ; জ্ঞানীর ভাষায় অজ্ঞের ন্যায় তর্ক করিয়া তােমার দুর্বলতা সমর্থন করিবার কোনও প্রয়ােজন নাই ৷ শােক মনুষ্যমাত্রের হৃদয়ে উৎপন্ন হয়, মনুষ্যমাত্র মরণ ও বিচ্ছেদ অতি ভয়ঙ্কর, জীবন মহামূল্য, শােক অসহ্য, কৰ্ত্তব্য কঠোর, স্বার্থসিদ্ধি মধুর বুঝিয়া হর্ষ করে, দুঃখ করে, হাসে, কাদে, কিন্তু এই সকল বৃত্তিকে কেহ জ্ঞানপ্রসূত বলে না ৷ যাহাদের জন্য শােক করা অনুচিত, তাহাদের জন্য তুমি শােক করিতেছ ৷ জ্ঞানী কাহারও জন্য শােক করেন না, – না মৃত ব্যক্তির জন্য, না জীবিত ব্যক্তির জন্য ৷ তিনি এই কথা জানেন – মরণ নাই, বিচ্ছেদ নাই, দুঃখ নাই, আমরা অমর, আমরা চিরকাল এক, আমরা আনন্দের সন্তান, অমৃতের সন্তান, জীবনের মরণের সঙ্গে, সুখ দুঃখের সঙ্গে এই পৃথিবীতে লুকোচুরি খেলা করিতে আসিয়াছি – প্রকৃতির বিশাল নাট্যগৃহে হাসিকান্নার অভিনয় করিতেছি, শত্রু মিত্র সাজিয়া যুদ্ধ ও শান্তি, প্রেম ও কলহের রস আস্বাদন করিতেছি ৷ এই যে অল্পকাল বাঁচিয়া থাকি, কাল পরশ্ব দেহত্যাগ করিয়া কোথায় যাইব জানি না, ইহা আমাদের অনন্ত ক্রীড়ার মধ্যে এক মহুর্ত মাত্র, ক্ষণিক খেলা, কয়েকক্ষণের ভাব ৷ আমরা ছিলাম, আমরা আছি, আমরা থাকিব – সনাতন, নিত্য, অনশ্বর - প্রকৃতির ঈশ্বর আমরা, জীবন-মরণের কর্তা, ভগবানের অংশ, ভূত বর্তমান ও ভবিষ্যতের অধিকারী ৷ যেমন দেহের বাল্য, যৌবন, জরা, তেমনই দেহান্তরপ্রাপ্তি, —মরণ নামমাত্র, নাম শুনিয়া আমরা ভয় পাই, দুঃখিত হই, বস্তু যদি বুঝিতাম ভয়ও পাইতাম , দুঃখিতও হইতাম না ৷ আমরা যদি বালকের যৌবনপ্রাপ্তিকে মরণ বলিয়া কাদিয়া বলিতাম, আহা আমাদের সেই প্রিয় বালক কোথায় গেল, এই যুবাপুরুষ সেই বালক নহে, আমার সােনারচঁাদ কোথায় গিয়াছে – আমাদের ব্যবহারকে সকলে হাস্যকর ও ঘাের অজ্ঞানজনিত বলিত; কেননা, এই অবস্থান্তরপ্রাপ্তি প্রকৃতির নিয়ম, বালকদেহে ও যুবকদেহে একই পুরুষ বাহ্য-পরিবর্তনের অতীত হইয়া স্থিরভাবে রহিয়াছেন ৷ জ্ঞানী, সাধারণ মানুষের মরণে ভয় ও মরণে দুঃখ দেখিয়া তাহার ব্যবহার ঠিক সেইভাবে হাস্যকর ও ঘাের অজ্ঞানজনিত বলিয়া দেখেন, কেননা দেহান্তরপ্রাপ্তি প্রকৃতির নিয়ম, স্থূলদেহে ও সূক্ষ্মদেহে একই পুরুষ বাহ্য পরিবর্তনের অতীত হইয়া স্থিরভাবে রহিয়াছেন ৷ অমৃতের সন্তান আমরা, কে মরে, কে মারে? মৃত্যু আমাদিগকে স্পর্শ করিতে পারে না, – মৃত্যু ফাকা আওয়াজ, মৃত্যু ভ্ৰম, মৃত্যু নাই ৷
মাত্রা
পুরুষ অচল, প্রকৃতি চল ৷ চল প্রকৃতির মধ্যে অচল পুরুষ অবস্থিত ৷ প্রকৃতিস্থ পুরুষ পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা যাহা দেখে, শােনে, আঘ্রাণ করে, আস্বাদ করে, স্পর্শ করে, তাহাই ভােগ করিবার জন্য প্রকৃতিকে আশ্রয় করে ৷ আমরা দেখি রূপ, শুনি শব্দ, আঘ্রাণ করি গন্ধ, আস্বাদ করি রস, অনুভব করি স্পর্শ ৷ শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ, এই পঞ্চ তন্মাত্রই ইন্দ্রিয়ভােগের বিষয় ৷ ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় মনের বিশেষ বিষয় সংস্কার ৷ বুদ্ধির বিষয় চিন্তা ৷ পঞ্চ তন্মাত্র এবং সংস্কার ও চিন্তা ৷ অনুভব ও ভােগ করিবার জন্য পুরুষ-প্রকৃতির পরস্পর সম্ভোগ ও অনন্ত ক্রীড়া ৷ এই ভােগ দ্বিবিধ, শুদ্ধ ও অশুদ্ধ ৷ শুদ্ধ ভােগে সুখ-দুঃখ নাই, পুরুষের চিরন্তন স্বভাবসিদ্ধ ধৰ্ম্ম আনন্দই আছে ৷ অশুদ্ধ ভােগে সুখ-দুঃখ আছে, শীতােষ্ণ, ক্ষুৎপিপাসা, হর্ষশােক ইত্যাদি দ্বন্দ্ব অশুদ্ধ ভােগীকে বিচলিত ও বিক্ষুব্ধ করে ৷ কামনা অশুদ্ধতার কারণ ৷ কামীমাত্রই অশুদ্ধ, যে নিষ্কাম, সে শুদ্ধ ৷ কামনায় রাগ ও দ্বেষ সৃষ্ট হয়, রাগদ্বেষের বশে পরুষ বিষয়ে আসক্ত হয়, আসক্তির ফল বন্ধন ৷ পুরুষ বিচলিত ও বিক্ষুব্ধ, এমনকি ব্যথিত ও যন্ত্রণাক্লিষ্ট হইয়াও আসক্তির অভ্যাসদোষে তাহার ক্ষোভ, ব্যথা বা যন্ত্রণার কারণ পরিত্যাগ করিতে অক্ষম হয় ৷
সমভাব
শ্রীকৃষ্ণ প্রথম আত্মার নিত্যতার উল্লেখ করিয়া পরে অজ্ঞানের বন্ধন শিথিল করিবার উপায় দেখাইলেন ৷ মাত্রা অর্থাৎ বিষয়ের নানারূপ স্পর্শ, সুখ, দুঃখ ইত্যাদি দ্বন্দ্বের কারণ ৷ এই স্পর্শসকল অনিত্য, তাহাদের আরম্ভও আছে, অন্তও আছে, অনিত্য বলিয়া আসক্তি পরিত্যাগ করিতে হয় ৷ অনিত্য বস্তুতে যদি আসক্ত হই, তাহার আগমনে হৃষ্ট হই, তাহার নাশে বা অভাবে দুঃখিত বা ব্যথিত হই ৷ এই অবস্থাকে অজ্ঞান বলে ৷ অজ্ঞানে অনশ্বর আত্মার সনাতন ভাব ও অন্বয় আনন্দ আচ্ছন্ন হয়, কেবল ক্ষণস্থায়ী ভাব ও বস্তুতে মত্ত হইয়া থাকি, তাহার নাশের দুঃখে শােকসাগরে নিমগ্ন হই ৷ এইরূপ অভিভূত না হইয়া যে বিষয়ের স্পর্শসকল সহ্য করিতে পারে, অর্থাৎ যে দ্বন্দ্ব উপলব্ধি করিয়াও সুখ-দুঃখে, শীতােষ্ণে, প্রিয়াপ্রিয়ে, মঙ্গলামঙ্গলে, সিদ্ধি-অসিদ্ধিতে হর্ষ ও শােক অনুভব না করিয়া সমানভাবে প্রফুল্লচিত্তে হাস্যমুখে গ্রহণ করিতে পারে, সে পুরুষ রাগদ্বেষ হইতে বিমুক্ত হয়, অজ্ঞানের বন্ধন কাটিয়া সনাতন ভাব ও আনন্দ উপলব্ধি করিতে সমর্থ হয়, – অমৃতত্বায় কল্পতে ৷
সমতার গুণ
এই সমতা গীতার প্রথম শিক্ষা ৷ সমতাই গীতােক্ত সাধনের প্রতিষ্ঠা ৷ গ্রীক স্তোয়িক সম্প্রদায় ভারত হইতে এই সমতার শিক্ষা লাভ করিয়া য়ুরােপে সমতা-বাদ প্রচার করিয়াছেন ৷ গ্রীক দার্শনিক এপিকুরস শ্রীকৃষ্ণ-প্রচারিত শিক্ষার আর একদিক ধরিয়া শান্তভােগের শিক্ষা, Epicureanism বা ভােগবাদ প্রচার করিলেন ৷ এই দুই মত, সমতাবাদ ও ভােগবাদ প্রাচীন য়ুরােপের শ্রেষ্ঠ নৈতিক মত বলিয়া জ্ঞাত ছিল, এবং আধুনিক য়ুরােপেও নব আকার ধারণ করিয়া Puritanism ও Paganismএর চির দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করিয়াছে ৷ কিন্তু গীতােক্ত সাধনে সমতাবাদ ও শান্ত বা শুদ্ধ ভােগ একই কথা ৷ সমতা কারণ, শুদ্ধ ভােগ কাৰ্য ৷ সমতায় আসক্তি মরে, রাগদ্বেষ প্রশমিত হয়, আসক্তি নাশে এবং রাগদ্বেষ প্রশমনে শুদ্ধতা জন্মায় ৷ শুদ্ধ পুরুষের ভােগ কামনা ও আসক্তিরহিত, অতএব শুদ্ধ ৷ ইহাতেই সমতার গুণ যে সমতার সহিত আসক্তি ও রাগদ্বেষ এক আধারে থাকিতে পারে না ৷ সমতাই শুদ্ধির বীজ ৷
দুঃখজয়
গ্রীক স্তোয়িক সম্প্রদায় এই ভুল করিলেন যে তাঁহারা দুঃখজয়ের প্রকৃত উপায় বুঝিতে পারেন নাই ৷ তাহারা দুঃখ নিগ্রহ করিয়া, ছাপাইয়া, পদে দলিত করিয়া দুঃখজয়ের চেষ্টা করিলেন ৷ কিন্তু গীতায় অন্যত্র বলিয়াছে, প্রকৃতিং যান্তি ভূতানি, নিগ্রহঃ কিং করিষ্যতি ৷ ভূতসকল নিজ প্রকৃতিকে অনুসরণ করে, নিগ্রহে কি হইবে? দুঃখনিগ্রহে মানবের হৃদয় শুষ্ক, কঠোর, প্রেমশূন্য হইয়া যায় ৷ দুঃখে অশ্রুজল মােচন করিব না, যন্ত্রণাবােধ স্বীকার করিব না, “এ কিছু নহে” বলিয়া নীরবে সহ্য করিব, স্ত্রীর দুঃখ, সন্তানের দুঃখ, বন্ধুর দুঃখ, জাতির দুঃখ অবিচলিত চিত্তে দেখিব, এই ভাব বলদৃপ্ত অসুরের তপস্যা – তাহার মহত্ব আছে, মানবের উন্নতিসাধনে প্রয়ােজনও আছে, কিন্তু ইহা দুঃখজয়ের প্রকৃত উপায় নহে, শেষ বা চরম শিক্ষা নহে ৷ দুঃখজয়ের প্রকৃত উপায় জ্ঞান, শান্তি, সমতা ৷ শান্তভাবে সুখ-দুঃখ গ্রহণ করাই প্রকৃত পথ ৷ প্রাণে সুখ-দুঃখের সঞ্চার বারণ করিব না, বুদ্ধি অবিচলিত করিয়া রাখিব ৷ সমতার স্থান বুদ্ধি, চিত্ত নহে, প্রাণ নহে ৷ বুদ্ধি সম হইলে, চিত্ত ও প্রাণ আপনিই সম হয়, অথচ প্রেম ইত্যাদি প্রকৃতিজাত প্রবৃত্তি শুকাইয়া যায় না, মানুষ পাথর হয় না, জড় ও অসাড় হয় না ৷ প্রকৃতিং যান্তি ভূতানি – প্রেম ইত্যাদি প্রকৃতির চিরন্তন প্রবৃত্তি, তাহার হাত হইতে পরিত্রাণ পাওয়ার একমাত্র উপায় পরব্রহ্মে লয় ৷ প্রকৃতির মধ্যে থাকিয়া প্রকৃতিবর্জন অসম্ভব ৷ যদি কোমলতা পরিত্যাগ করি, কঠোরতা হৃদয়কে অভিভূত করিবে, – যদি বাহিরে দুঃখের স্পন্দন নিষেধ করি, দুঃখ ভিতরে জমিয়া থাকিবে এবং অলক্ষিতভাবে প্রাণকে শুকাইয়া দিবে ৷ এইরূপ কৃচ্ছসাধনে উন্নতির সম্ভাবনা নাই ৷ তপস্যায় শক্তি হইবে বটে কিন্তু এই জন্মে যাহা ছাপাইয়া রাখিলাম, পরজন্মে তাহা সৰ্বরােধ ভাঙ্গিয়া দ্বিগুণ বেগে উছলিয়া আসিবে ৷
Home
Sri Aurobindo
Books
Bengali
Share your feedback. Help us improve. Or ask a question.