All writings in Bengali and Sanskrit including brief works written for the newspaper 'Dharma' and 'Karakahini' - reminiscences of detention in Alipore Jail.
All writings in Bengali and Sanskrit. Most of the pieces in Bengali were written by Sri Aurobindo in 1909 and 1910 for 'Dharma', a Calcutta weekly he edited at that time; the material consists chiefly of brief political, social and cultural works. His reminiscences of detention in Alipore Jail for one year ('Tales of Prison Life') are also included. There is also some correspondence with Bengali disciples living in his ashram. The Sanskrit works deal largely with philosophical and cultural themes. (This volume will be available both in the original languages and in a separate volume of English translations.)
আমাদের দেশে ও য়ুরােপে মুখ্য প্রভেদ এই যে, আমাদের জীবন অন্তর্মুখী, য়ুরােপের জীবন বহির্মুখী ৷ আমরা ভাবকে আশ্রয় করিয়া পাপপুণ্য ইত্যাদি বিচার করি, য়ুরােপ কৰ্ম্মকে আশ্রয় করিয়া পাপপুণ্য ইত্যাদি বিচার করে ৷ আমরা ভগবানকে অন্তর্যামী ও আত্মস্থ বুঝিয়া অন্তরে তাঁহাকে অন্বেষণ করি, য়ুরােপ ভগবানকে জগতের রাজা বুঝিয়া বাহিরে তাহাকে দেখে ও উপাসনা করে ৷ য়ুরােপের স্বর্গ স্থলজগতে, পৃথিবীর ঐশ্বৰ্য্য, সৌন্দৰ্য্য, ভােগ-বিলাস তাহাদের আদরণীয় ও মৃগ্য; যদি অন্য স্বর্গ কল্পনা করেন, তাহা এই পার্থিব ঐশ্বৰ্য্য, সৌন্দৰ্য্য ভােগ-বিলাসের প্রতিকৃতি, তাহাদের ভগবান আমাদের ইন্দ্রের সমান, পার্থিব রাজার ন্যায় রত্নময় সিংহাসনে আসীন হইয়া সহস্র বন্দনাকারী দ্বারা স্তবস্তুতিতে স্ফীত হইয়া বিশ্বসাম্রাজ্য চালান ৷ আমাদের শিব পরমেশ্বর, অথচ ভিক্ষুক, পাগল, ভােলানাথ, আমাদের কৃষ্ণ বালক, হাস্যপ্রিয়, রঙ্গময়, প্রেমময়, ক্রীড়া করা তাহার ধর্ম ৷ য়ুরােপের ভগবান কখন হাসেন না, ক্রীড়া করেন না, তাহাতে তাহার গৌরব নষ্ট হয়, তাহার ঈশ্বরত্ব আর থাকে না ৷ সেই বহির্মুখী ভাব ইহার কারণ – ঐশ্বর্য্যের চিহ্ন তাহাদের ঐশ্বর্যের প্রতিষ্ঠা, চিহ্ন না দেখিলে তঁাহারা জিনিষটী দেখিতে পান না, তাহাদের দিব্যচক্ষু নাই, সূক্ষ্মদৃষ্টি নাই, সবই স্থূল ৷ আমাদের শিব ভিক্ষুক, কিন্তু ত্রিলােকের সমস্ত ধন ও ঐশ্বৰ্য্য অল্পেতে সাধককে দান করেন ভােলানাথ, কিন্তু জ্ঞানীর অপ্রাপ্য জ্ঞান তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ সম্পত্তি ৷ আমাদের প্রেমময় রঙ্গপ্রিয় শ্যামসুন্দর কুরুক্ষেত্রের নায়ক, জগতের পাতা, অখিল ব্রহ্মাণ্ডের সখা ও সুহৃদ ৷ ভারতের বিরাট জ্ঞান, তীক্ষ সূক্ষ্মদৃষ্টি, অপ্রতিহত দিব্যচক্ষু স্থূল আবরণ ভেদ করিয়া আত্মস্থ ভাব, আসল সত্য, অন্তর্নিহিত গুঢ়তত্ত্ব বাহির করিয়া আনে ৷
পাপপুণ্য সম্বন্ধেও সেই ক্রম লক্ষিত হয় ৷ আমরা অন্তরের ভাব দেখি ৷ নিন্দিত কর্মের মধ্যে পবিত্র ভাব, বাহ্যিক পুণ্যের মধ্যে পাপিষ্ঠের স্বার্থ লুক্কায়িত থাকিতে পারে; পাপপুণ্য, সুখদুঃখ মনের ধৰ্ম্ম, কৰ্ম্ম আবরণ মাত্র ৷ আমরা ইহা জানি; সামাজিক সুশৃঙ্খলার জন্য আমরা বাহ্যিক পাপপুণ্যকে কর্মের প্রমাণ বলিয়া মান্য করি, কিন্তু অন্তরের ভাবই আমাদের আদরণীয় ৷ যে সন্ন্যাসী আচার-বিচার, কর্তব্য-অকর্তব্য, পাপপুণ্যের অতীত, মদোন্নত্ত-পিশাচবৎ আচরণ করেন, সেই সৰ্ব্বধৰ্ম্মত্যাগী পুরুষকে আমরা শ্রেষ্ঠ বলি ৷ পাশ্চাত্য বুদ্ধি এই তত্ত্বগ্রহণে অসমর্থ; যে জড়বৎ আচরণ করে, তাহাকে জড় বুঝে, যে উন্মত্তবৎ আচরণ করে, তাহাকে বিকৃতমস্তিষ্ক বুঝে, যে পিশাচবৎ আচরণ করে, তাহাকে ঘৃণ্য অনাচারী পিশাচ বুঝে; কেননা সূক্ষ্মদৃষ্টি নাই, তাহারা অন্তরের ভাব দেখিতে অসমর্থ ৷
সেইরূপ বাহ্যদৃষ্টিপরবশ হইয়া য়ুরােপীয় পণ্ডিতগণ বলেন, ভারতে প্রজা-তন্ত্র কোনও যুগে ছিল না ৷ প্রজাতন্ত্রসূচক কোনও কথা সংস্কৃত ভাষায় পাওয়া যায় না, আধুনিক পার্সিয়ামেন্টের ন্যায় কোন আইন-ব্যবস্থাপক সভাও ছিল না, প্রজাতন্ত্রের বাহ্যচিহ্নের অভাবে প্রজাতন্ত্রের অভাব প্রতিপন্ন হয় ৷ আমরাও এই পাশ্চাত্য যুক্তি যথার্থ বলিয়া গ্রহণ করিয়া আসিয়াছি ৷ আমাদের প্রাচীন আৰ্য্যরাজ্যে প্রজাতন্ত্রের অভাব ছিল না; প্রজাতন্ত্রের বাহ্যিক উপকরণ অসম্পূর্ণ ছিল বটে, কিন্তু প্রজাতন্ত্রের ভাব আমাদের সমস্ত সমাজ ও শাসনতন্ত্রের অন্তরে ব্যাপ্ত হইয়া প্রজার সুখ ও দেশের উন্নতি রক্ষা করিত ৷ প্রথমতঃ, প্রত্যেক গ্রামে সম্পূর্ণ প্রজাতন্ত্র ছিল, গ্রামের লােক সম্মিলিত হইয়া সৰ্ব্বসাধারণের পরামর্শে বৃদ্ধ ও নেতৃস্থানীয় পুরুষদের অধীনে গ্রামের ব্যবস্থা, সমাজের ব্যবস্থা করিতেন; এই গ্রাম্য প্রজাতন্ত্র মুসলমানদের আমলে অক্ষুন্ন রহিল, বৃটিশ শাসনতন্ত্রের নিষ্পেষণে সেইদিন নষ্ট হয় ৷ দ্বিতীয়তঃ, প্রত্যেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যেও, যেখানে সর্বসাধারণকে সম্মিলিত করিবার সুবিধা ছিল, সেইরূপ প্রথা বিদ্যমান ছিল; বৌদ্ধ সাহিত্যে, গ্রীক ইতিহাসে, মহাভারতে ইহার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় ৷ তৃতীয়তঃ, বড় বড় রাজ্যে, যেখানে এইরূপ বাহ্যিক উপকরণ থাকা অসম্ভব, প্রজাতন্ত্রের ভাব রাজ-তন্ত্রকে পরিচালিত করিত ৷ প্রজার আইন-ব্যবস্থাপক সভা ছিল না, কিন্তু রাজারও আইন করিবার বা প্রবর্তিত আইন পরিবর্তন করিবার লেশমাত্র অধিকার ছিল না ৷ প্রজারা যে আচারব্যবহার রীতিনীতি আইনকানুন মানিয়া আসিতেছিল, তাহার রক্ষাকর্তা রাজা ৷ ব্রাহ্মণগণ আধুনিক উকিল ও জজদের ন্যায় সেই প্রজা-অনুষ্ঠিত নিয়মসকল রাজাকে বুঝাইনে, সংশয়স্থলে নির্ণয় করিতেন, ক্রমে ক্রমে যে পরিবর্তন লক্ষ্য করিতেন, তাহা লিখিতশাস্ত্রে লিপিবদ্ধ করিতেন ৷ শাসনের ভার রাজারই ছিল, কিন্তু সেই ক্ষমতাও আইনের কঠিন নিগড়ে নিবদ্ধ; তাহা ভিন্ন রাজা প্রজার অনুমােদিত কাৰ্য্যই করিবেন, প্রজার অসন্তোষ যাহাতে হয়, তাহা কখন করিবেন না, এই রাজনীতিক নিয়ম সকলেই মানিয়া চলিত ৷ রাজা তাহার ব্যতিক্রম করিলে, প্রজারা আর রাজাকে মান্য করিতে বাধ্য ছিল না ৷
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের একীকরণ এই যুগের ধর্ম ৷ কিন্তু এই একীকরণে পাশ্চাত্যকে প্রতিষ্ঠা বা মুখ্য অঙ্গ যদি করি, আমরা বিষম ভ্রমে পতিত হইব ৷ প্রাচ্যই প্রতিষ্ঠা, প্রাচ্যই মুখ্য অঙ্গ ৷ বহির্জগৎ অন্তর্জগতে প্রতিষ্ঠিত, অন্তর্জগৎ বহির্জগতে প্রতিষ্ঠিত নহে ৷ ভাব ও শ্রদ্ধা শক্তি ও কর্মের উৎস, ভাব ও শ্রদ্ধা রক্ষা করিতে হয়, কিন্তু শক্তিপ্রয়ােগে ও কর্মের বাহ্যিক আকারে ও উপকরণে আসক্ত হইতে নাই ৷ পাশ্চাত্যেরা প্রজাতন্ত্রের বাহ্যিক আকার ও উপকরণ লইয়া ব্যস্ত ৷ ভাবকে পরিস্ফুট করিবার জন্য বাহ্যিক আকার ও উপকরণ; ভাব আকারকে গঠন করে, শ্রদ্ধা উপকরণ সৃজন করে ৷ কিন্তু পাশ্চাত্যেরা আকারে ও উপকরণে এমন ৷ আসক্ত যে, সেই বহিঃপ্রকাশের মধ্যে ভাব ও শ্রদ্ধা মরিয়া যাইতেছে, তাহা লক্ষ্য করিতে পারেন না ৷ আজকাল প্রাচ্য দেশে প্রজাতন্ত্রের ভাব ও শ্রদ্ধা প্রবলবেগে পরিস্ফট হইয়া বাহ্য উপকরণ সুজন করিতেছে, বাহ্য আকার গঠন করিতেছে, কিন্তু পাশ্চাত্য দেশে সেই ভাব ম্লান হইতেছে, সেই শ্রদ্ধা ক্ষীণ হইতেছে ৷ প্রাচ্য প্রভাতােনুখ, আলােকের দিকে ধাবিত – পাশ্চাত্য তিমিরগামী রাত্রির দিকে ফিরিয়া যাইতেছে ৷
---=
ইহার কারণ, সেই বাহ্য আকার ও উপকরণে আসক্তির ফলে প্রজাতন্ত্রের দুস্পরিণাম ৷ প্রজাতন্ত্রের সম্পূর্ণ অনুকূল শাসনতন্ত্র সৃজন করিয়া আমেরিকা এতদিন গর্ব করিতেছিল যে আমেরিকার তুল্য স্বাধীন দেশ জগতে আর নাই ৷ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রেসিডেন্ট ও কর্মচারীগণ কংগ্রেসের সাহায্যে স্বেচ্ছায় শাসন করেন, ধনীর অন্যায়, অবিচার ও সর্বগ্রাসী লােভকে আশ্রয় দেন, নিজেরাও ক্ষমতার অপব্যবহারে ধনী হন ৷ একমাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের সময়ে প্রজারা স্বাধীন, তখনও ধনীসকল প্রচুর অর্থব্যয়ে নিজ ক্ষমতা অক্ষুন্ন রাখেন, পরেও প্রজার প্রতিনিধিগণকে কিনিয়া স্বেচ্ছায় অর্থশােষণ করেন, আধিপত্য করেন ৷ ফ্রান্স প্রজাতন্ত্র ও স্বাধীনতার জন্মভূমি, কিন্তু যে কর্মচারীবর্গ ও পুলিস প্রজার ইচ্ছায় প্রত্যেক শাসনকার্য চালাইবার যন্ত্রস্বরূপ বলিয়া সৃষ্ট হইয়াছিল, তাহারা এখন বহুসংখ্যক ক্ষুদ্র স্বেচ্ছাচারী রাজা হইয়া বসিয়াছে, প্রজারা তাহাদের ভয়ে কাতর ৷ ইংলণ্ডে এইরূপ বিভ্রাট ঘটে নাই বটে, কিন্তু প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য বিপদ পরিস্ফুট হইতেছে ৷ চঞ্চলমতি অর্ধশিক্ষিত প্রজার প্রত্যেক মতপরিবর্তনে শাসনকাৰ্য্য ও রাজনীতি আলােড়িত হয় বলিয়া বৃটিশজাতি পুরা রাজনীতিক কুশলতা হারাইয়া বাহিরে অন্তরে বিপদগ্রস্ত হইয়াছে ৷ শাসনকর্তাগণ কর্তব্যজ্ঞানরহিত, নিজ স্বার্থ ও প্রতিপত্তি রক্ষা করিবার জন্য নির্বাচকবর্গকে প্রলােভন দেখাইয়া, ভয় দেখাইয়া, ভুল বুঝাইয়া বৃটিশজাতির বুদ্ধি বিকৃত করিতেছেন, মতির অস্থিরতা ও চাঞ্চল্যবর্ধন করিতেছেন ৷ এই সকল কারণবশতঃ একদিকে প্রজাতন্ত্রবাদ ভ্রান্ত বলিয়া একদল স্বাধীনতার বিরুদ্ধে খঙ্গহস্ত হইয়া উঠিতেছে, অপরদিকে আনার্কিষ্ট, সােশালিষ্ট, বিপ্লবকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি হইতেছে ৷ এই দুই পক্ষের সংঘর্ষ ইংলণ্ডে চলিতেছে – রাজনীতিক্ষেত্রে; আমেরিকায় – শ্রমজীবী ও লক্ষপতির বিরােধে; জৰ্ম্মণীতে – মত-সংগঠনে; ফ্রান্সে – সৈন্যে ও নৌ-সৈন্যে; রুশে – পুলিস ও হত্যাকারীর সংগ্রামে —সর্বত্র গণ্ডগােল, চঞ্চলতা, অশান্তি ৷
বহির্মুখী দৃষ্টির এই পরিণাম অবশ্যম্ভাবী ৷ কয়েকদিন রাজসিক তেজে তেজস্বী হইয়া অসুর মহান্ শ্রীসম্পন্ন, অজেয় হয়, তাহার পরে অন্তর্নিহিত দোষ বাহির হয়, সব ভাঙ্গিয়া চুরমার হয় ৷ ভাব ও শ্রদ্ধা, সজ্ঞান কৰ্ম্ম, অনাসক্ত কৰ্ম্ম যে দেশে শিক্ষার মূলমন্ত্র, সেই দেশেই অন্তর ও বাহির, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের একীকরণে সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতির সকল সমস্যার সন্তোষজনক মীমাংসা কাৰ্যতঃ হইতে পারে ৷ কিন্তু পাশ্চাত্য জ্ঞান ও শিক্ষার বশবর্তী হইয়া সেই মীমাংসা ৷ করিতে পারিব না ৷ প্রাচ্যের উপর দণ্ডায়মান হইয়া পাশ্চাত্যকে আয়ত্ত করিতে হইবে ৷ অন্তরে প্রতিষ্ঠা, বাহিরে প্রকাশ ৷ ভাবের পাশ্চাত্য উপকরণ অবলম্বন করিলে বিপদগ্রস্ত হইব, নিজ স্বভাব ও প্রাচ্যবুদ্ধির উপযুক্ত উপকরণ সৃজন করিতে হইবে ৷
Home
Sri Aurobindo
Books
Bengali
Share your feedback. Help us improve. Or ask a question.